Powered By Blogger

My Blog List

Popular Posts

স্বাগতম

আমার ব্লগে আপনাকে স্বাগত জানাচ্ছি

Total Pageviews

Pages

Sunday, November 16, 2008

কবির অর্ন্তদৃষ্টি,কবিতার যোজন গ্রহপথ


কবির অর্ন্তদৃষ্টি,কবিতার যোজন গ্রহপথ
ফকির ইলিয়াস
===========================================
"[sb]Poets are the unacknowledged legislators of the world."
------- Percy Bysshe Shelley[/sb]
ভিন ভাষা থেকে যখন একটি কবিতা অনুবাদ করা হয়, তখন সঙ্গত কারণেই পাঠকের ইচ্ছে জাগে
মূল ভাষার সাথে কবিতাটিকে মিলিয়ে দেখার। কারণ তাতে জানা এবং বুঝা যায় অনুদিত কবিতাটি কতোটা মৌলিকতা রক্ষা করতে পেরেছে। মার্কিন কবি জেরালন্ড ষ্টার্ণ এর কবিতার বই ‘‘এভরিথিং
ইজ বার্নিং’’(নরটন এন্ড কোম্পানী , ২০০৫) বের হবার পর একটি সমালোচনা ছাপা হয় দ্যা নিউইয়র্ক টাইমসের বুক রিভিউ সেকশনে। সে আলোচনায় কবির কিছু কবিতার ভাবার্থ নিয়ে প্রশ্ন তোলা হয়। কবি ষ্টার্ণ তার প্রতিক্রিয়ায় বলেন ,তাই বলেতো আমি আমার কবিতা আবার রিরাইট করতে পারিনা! কবি বলেন,আমার দৃষ্টির সাথে সবার দৃষ্টির মিল থাকবে আমিতো সে কথাও বলছি না।
অনেকগুলো দৃশ্য, কবির চোখের সামনেই মিলিয়ে যায়। কবি তা ধরে রাখেন। পরে সাজিয়ে নেন নিজের মতো করে। আমাদের চারপাশে আমরা প্রতিদিন যে অসংখ্য পংক্তিমালা দেখি , তার সবগুলো কি আমাদের মন কাড়ে? না, কাড়ে না। কবি যে পথে হাঁটছেন , পাঠককে সে পথে হাঁটতে
হবে এমন কোনো কথাও নেই। শিল্প-সাহিত্যে একটা আবহ সবসময় বাস্তবতাকে ঘিরে রাখে।
একটা ছবির আঁচড় ও তো অনেক কথা বলে যায়। সেকথা বুঝতে পারে ক’জন ? ক’জনের মন দেয় এগুলোকে মেধার ছাড়পত্র ?
কবিতা মনের দ্যোতনা ছড়াতে,লিখিত হয় বার বার। আর পঠিত হয় তার চেয়েও বহুগুণ বেশী।এর কারণ একটাই । সবাই লিখতে পারে না। তারপরও মগ্ন উপাসনায় ঋজু হতে চায় সকল বিশুদ্ধ অন্তর।
[sb] যজ্ঞ করি। আগুনে ঢালছি মেঘ। সমুদ্র ও ঝড়
আগুনে ঢালছি আগুন। ঢালছি ঈশ্বরে ঈশ্বর
নিজেকেও ছুঁড়ে ফেলে দিই
স্বাহা বলে ফেলি আকাশের যাবতীয় ঘি

অগ্নি থেকে অগ্নি উঠে আসে। মেঘ থেকে জল
সমুদ্র ফাটিয়ে ওঠে গেঁড়িভুক শোকনীল নাবিকের দল
আমি যজ্ঞ করি আর আগুনের মধুগুলি চেটেপুটে খাই
নিজেরেও সমগ্র পোড়াই

জঙ্গল শুন্য করে ছুটে আসে গাছপালা, গুল্ম ও লতা
ছায়াপথ শুন্য করে ছুটে আসে অন্ধ নীরবতা
মাটি ফুঁড়ে ওঠে আসে ওঁম তৎ সৎ
যজ্ঞ করি। নিজেকে আগুনে ঢালি। পোড়ে ভবিষৎ ।
( যজ্ঞ / বিকাশ সরকার )[/sb][si][/si]
কবি যাই বলুন না কেন, ভবিষ্যতই নির্মিত হয় আগুয়ান প্রজন্মের হাতে। যারা এই সমকালকে শিয়রের বালিশ করে মহাকালের কোলে নিশিরাত ঘুমায় । আবার জাগে। প্রতিদিন নতুন সূর্য কামনা করে।
[sb]দুই[/sb]
আমাদের মননে , বাংলা সাহিত্যে শামসুর রাহমান এক উজ্জ্বল নক্ষত্র। তাঁর মুখ থেকে জীবনের শেষ
মুহুর্ত পর্যন্ত আমরা শুনেছি আশার বানী।
বাংলাদেশ যখন জঙ্গীদের লীলাক্ষেত্র , কবি বলেছেন - এ আঁধার কেটে যাবে। এই যে স্বপ্নচারী মন,
সেই মনের মেরুপথেই হাঁটে কবিতা।
যুগে যুগে বদলে যায় কবিতার ক্ষেত্র। বদলে কবির অভিজ্ঞতাও ।

[sb]একটা মুদ্রা পেলেই অমনি আমি কুয়ার জলে ফেলে দিতাম। তোমার চোখের মতো,যে মুদ্রার এপিঠ ওপিঠ দু’পিঠেই থাকে ঈশ্বর , মুদ্রা পতনের সাথে সাথে ঈশ্বর কেঁদে উঠতো , আর তার কান্নার ভেতর দেখতে পেতাম অদৃশ্য এক ঘোড়া ,যে ঘোড়া ঘাড়েকরেছে সূর্য , পায়ের ভেতর নিয়েছে দৌড়ের পদাবলী সেই জন্মাবধী, একটাভোররাতের পাশে দাঁড়িয়ে আছো তুমি আলোর পাথর আর সেখানে পড়ে আছে নর্তকীদের ভাঙা পা , কেবল আমার হাতে একটা মুদ্রা এলেই কুয়ার জলে জমে ওঠেঈশ্বরের কান্না, ভেসে ওঠে মুদ্রার শ্বাপদ আর তোমার পৌরাণিক গায়ে জমে ওঠে ভোররাতের লীলা।
( পাথর শুধু অন্ধকার হতে থাকে -চার / জুয়েল মোস্তাফিজ )[/sb][si][/si]
কবিতার এমন নবতর আকাংখা প্রতিদিনই উঠে আসে। নিয়ত মৃত্তিকাকে সামনে রেখে কবি
ভেসে যান বৃষ্টিসমুদ্রে। আর তা তাবৎ মানুষের অলৌকিক সমষ্টি শক্তিই বলা যায়।
একটা কথা আমরা সবাই জানি , মানুষের মনোজগতে একধরনের গোপন আড়াল সব সময়ই থেকে যায়। মানুষ মূলতঃই একা এবং অভিন্ন। বেদনার বর্ষায় লিখিত কোনো কবিতার চিত্রলকল্প তাই হয়তো প্রতিটি মনকে এককভাবেই দোলা দেয়। ঢেউ জাগিয়ে নিয়ে যায়
অন্যস্রোতে। স্মরণ করতে পারি জীবনানন্দ দাশকে আবারো বিনয়ের সাথে।
[sb]এখানে নক্ষত্রে ভরে রয়েছে আকাশ
সারাদিন সূর্য আর প্রান্তরের ঘাস ;
ডালপালা ফাঁক করে উঁচু উঁচু গাছে
নীলিমা কি চায় যেন আমাদের পৃথিবীর কাছে।

চারদিকে আলোড়িত রোদের ভিতরে
অনেক জলের শব্দে দিন
হূদয়ের গ্লানি ক্ষয় কালিমা মুছিয়ে
শুশ্রুষার মতো অন্তহীন।
( এখানে নক্ষত্রে ভরে / জীবনানন্দ দাশ)[/sb][si][/si]
এই যে অমর শুশ্রুষা, তা ই মানুষকে আলো দেয় যোগাত্মক নিয়মে। এর কোনো বিকল্প নাই। আর নাই বলেই একজন বাউল কবি কিংবা একজন নাগরিক কবি দুজনেই এসে মিলিত হয়ে যান একই সড়কে। যে সড়ক ধারণ করে চলেছে অগণিত পদচিহ¡। অগণিত নোখের আঁচড়।
তাই সমকালের একজন কবিও খুঁজেন সেই অদৃশ্যতাকে। তার কণ্ঠ হয়ে উঠে সবকালের কোনো সমর্পিত কবিকণ্ঠ।
[sb]যে বুঝে বেদনার কথা
তারে ডাকি স্বজনের নামে
তার নামে ডাক পাঠাই দু’চোখের খামে
যে পাবার সে পেয়েছে
কথার মাহাত্ম্য গোপন রেখেছে সেইজন
নিঃশব্দে, আমার মুখে সে পড়ে
ভিতর ভাঙে ধীরে ইচ্ছে আলোড়ন।
( অদৃশ্য / মাশুক ইবনে আনিস )[/sb][si][/si]
এই ধীরে বয়ে যাওয়া প্রশ্বাসই কবিকে দিয়ে লিখিয়ে নেয় কালের কবিতা।
[sb]তিন[/sb]
একজন কবি বলতেই পারেন, আমার নিজস্ব কোনো ঘর নেই। এই পৃথিবীটাই আমার
ঘর। আমার নিজস্ব কোনো ভাষা নেই, মানবসত্তার নিঃশ্বাসই আমার ভাষা।
কার্তিকের মাঠে দাঁড়িয়ে আছেন কবি। আর ক’দিন পরেই অগ্রহায়ন। আমার কেন জানি মনে হয় ‘গ্রহন’ শব্দটির সাথে আগ্রহায়ন মাসের একটা মিল কোথাও আছে। ফসল তোলার দিনকে সামনে রেখে মানুষ তার ভবিষ্যতের স্বপ্ন নির্মাণ করে যায় নিরন্তর।
প্রেমিকাকে জানিয়ে দেয় , সামনে শুভদিন। আদিকাল থেকে এই যে শুভদিনের প্রত্যাশা, তা ই একেকটা কবিতা।
[sb]দারচিনি দিনে- - - দিঘীমুখি হয়েছে মেঘ
সুষম প্রমোদে
এই প্রবণ - পাখি জানে
কী র- আছে পরাণে।
এখন সন্ধ্যার ডাকে - - - চাঁদ ফেরে
তোমার ধারণা গাঁয়
বেহাত বৈভবে একদিন তুমি
জেনে যাবে লীঢ় অনুরাগ
বিতং বিজনে থেকে যাই আজ।
( থেকে যাই আজ / ফজলুররহমান বাবুল )[/sb][si][/si]
বিশ্বের কোথায় কি কবিতা লিখা হচ্ছে তা জানা , খোঁজা এবং বুঝা কেও একজন প্রকৃত কবির দায়িত্ব বলে আমি মনে করি। কারণ ,কবিতার সমকালকে না জানলে বিবর্তন সম্পর্কে ধারণা পাওয়া কঠিন।
শেলী বলেছেন , কবিরা হচ্ছেন বিশ্বের অস্বীকৃত সংবিধান নির্মাতা। যারা কালে কালে মানব সভ্যতার কাঠামো নির্মাণ করে যান।
মার্কিন কবি জ্যাক গিলবার্ট বলেন ,আমাকে পড়তে হয়। সমসাময়িক কবিতা না পড়লে নিজেকে লাইনচ্যুত ট্রেন মনে হয়।
আগামীর কবিতা কেমন হবে তা কেউ বলতে পারবে না। তবে কবি তার কল্পসুতো টেনে রেখে যাবেন সুন্দর ভবিতব্যের জন্য।
[sb]যে কথা বাতাসে কোকিল হয়ে ওড়ে কেবল তারই
আঁচড়ের স্বর শুনি; পাতার মধ্যে শুয়ে পড়ে
আকাশমুখী পাখিগুলিকে বানাই কানের দুল।
দগ্ধলতায় , বনমানুষের পাড়ায় দূর নদীতে লঞ্চ চলার শব্দে
জমে ওঠে বাতি পোড়া অরিন্দমি নিরবতা । নঝুম জোনাকির
আলোকগন্ধে নাকফুলে বাজাই বিজলীর তবলা;
দূর চলে আসে ক্রমশঃ গলির মোড়ের চায়ের স্টলে
মাথায় পিয়ানো বাজানো সবুজ বালিশ পেতে।
( সোনার হ্যারিকেন ও শিস বাজানো মাছ - সিরিজ / ফেরদৌস মাহমুদ[/sb][si][/si] )
কবিতাকে এগিয়ে নিয়ে যাবার দায়িত্ব কারো একার নয়। সবার । সকলের। যারা লিখবে, যারা পড়বে। অনুপ্রাসের যে ধ্যানগরিমা, তার অমিত তেজ কেউ নেবে কি নেবে না,সে স্বাধীনতা সবার হাতে পৌঁছে দিয়েই কবিতা এগিয়ে যেতে ভালোবাসে।
[sb]সমুদ্র নিকটে আসে বহু বহুবার মানুষ আসে না ।
আকাশ অনেক বাসে বহু বহুবার মানুষ বাসে না।
( বিনয় মজুমদার প্রসঙ্গে একটা কবিতা / অশোক দাশগুপ্ত )[/sb][si][/si]
কবিতার এই নক্ষত্র রাজ্যে কবির বুনন যে সিঁড়ি তৈরি করে যায় , তা মহাকালে সমর্পিত হবে
এই বিশ্বাস ই আরেকটা কবিতার জন্ম দেয়।
[sb]চার [/sb][si][/si]
একটি কবিতা কতোটা কবিতা হয়ে উঠলো সে বিষয়ে কবির কতোটা খেয়াল রাখা দরকার , তা নিয়েও ভিন্নমত থাকতে পারে। কিন্তু সর্বোপরি কবি যদি যা ইচ্ছে তা,লিখে কবিতা বলে চালিয়ে দিতে
চান তাও বর্জন করার অধিকার রাখে মহাকাল।
[sb]মানুষের সবকথা শেষ হয়ে গেল এইখানে এসে
সারদিন সারারাত ভোরের রৌদ্র-বাদল শেষে-
অনেক মৃতের হাড় গড়িয়ে পড়েছে ক্রমশঃ নিঝুম
প্রান্তরের দিকে- আর তোমার চোখের মণিতে ঘুম
আর মৃত্যু নিয়ে , ভালোবাসা নিয়ে তারা রাতজাগা জলের কুসুম
নিয়ে-মানুষ কেন এসেছিল একদিন যদি আর না-ই পাবে ওম ?
তুমিও বা এসেছিলে কেন? মগ্ন-জোৎসনার রাতে
কেন তুমি এসেছিলে ফড়ি- সকাল নিয়ে হাতে?
বলে না সে -‘না’ -বলা মুখের পরে এসব উত্তর
নির্জনে লিখে রেখে গেছে সেই শতাব্দীর স্বর ।
(মধু বৃক্ষ প্রতারণা বিষ - চৌদ্দ / আলফ্রেড খোকন )[/sb][si][/si]
লিখে যাবার জন্যই হয়তো এসেছিল সবাই । কিন্তু পারেনি। পারছে না। অনেকে একজন কবিকে দশকের বৃত্তে বন্দি করতে চান না। কবিতার ইতিহাস বলে , যে কোনো কবির কবিতায় তার সমকালের ছাপ পড়বেই। দশক বরং মেধার সাথে বয়সের সমন্নয় ঘটিয়ে কবির নিজস্ব পরিমন্ডল
গড়ে তুলে।তার পরিচয়ের বিকাশ ঘটায়।ইউরোপ-আমেরিকার নামী প্রকাশনীগুলো তাই দশকওয়ারি কবিতার সংকলন প্রকাশ করে সে সময়ের দলিল প্রণয়ন করতে আগ্রহ দেখায়। সহস্র যোজন পথের উৎসমুখ তৈরি করে রাখে। সবচেয়ে বড়কথা হচ্ছে নিজের পদছাপ রেখে যাবার কৃতিত্ব। যা কেবল একজন ধ্যানী কবিই পারেন।
ক’জন নবীতম কবির জবানীতে এমন কিছু চিত্রকল্প দেখা যাক।
[sb]১ প্রতি সন্ধ্যায় পুরোনো গাঙুর নদীটি উৎসবের সুরে
ভাঙ্গতে ভাঙ্গতে দু’তীর বেহুলার মতো মূক হয়ে যায়
আমার লখিন্দর ভাইটি তবু জেগে উঠে না বিস্মরণের ভোরে
( রোদ রঙ ঘোড়া চরিত/ সুমন সুপান্থ )
২ অই যে পূর্বাকাশে লাল পাগড়ি ওড়াচ্ছেন প্রতি প্রত্যুষে
উনি অহম
অই যে লজিং মাস্টার সন্ধ্যার ফ্রক দেখছেন খুঁটে খুঁটে
উনি ঈর্ষা
( শিরোনামহীন-১২ / মাজুল হাসান )
৩ পর্যাপ্ত প্রবাসে উড়ে যাও পাখি
আমি রাখি প্রহরায় - ফেলে যাওয়া পালকের স্তুপ
গতকাল থেকে এল নিশ্চুপ গান , ফের মুখোমুখি
( পাখিকাতরতা / ইফতেখার ইনান )
৪ এ শহরে কারো কারো রাত সঙ্গম মুখর
আর কেউ কেউ বেদনার সুতো বোনে-
রাত এলে পরে
নিজের কবর নিজেই খুঁড়তে শুরু করে
( রাত নেমে এলে / আসমা বীথি )
কবিতা জীবনের উদ্ধার এনে দেয়।কবিতা মহাসাগরের তীরে বসে একজন মানুষকে আত্মমগ্ন
হতে শেখায়। আমার সবসময়ই মনে হয় একটি দীর্ঘ কবিতার কক্ষপথে পরিভ্রমন করছে
আপামর সৃষ্টিকুল। # #
-----------------------------------------------------------------------------
দৈনিক ডেসটিনি/ ২৩ মে ২০০৮ শুক্রবার প্রকাশিত

Saturday, November 15, 2008

ক্রান্তিকালের নির্বাচন ও গণবিচ্ছিন্ন রাষ্ট্ররক্ষকেরা


ক্রান্তিকালের নির্বাচন ও গণবিচ্ছিন্ন রাষ্ট্ররক্ষকেরা
ফকির ইলিয়াস
---------------------------------------------------------------------------------
একটি রাষ্ট্রের রক্ষক কিংবা ত্রাতা কখনই কোন ব্যক্তি কিংবা গোষ্ঠী হতে পারে না। একটি দেশে তার নিজস্ব প্রকল্পের পরিভ্রমণ থাকে। প্রজন্ম বেড়ে ওঠে। যোগ্য নেতৃত্ব সামনে এগিয়ে আসে। এক সময় তারা রাষ্ট্রের নেতৃত্বভার গ্রহণ করে। এটাই হচ্ছে স্বাভাবিক নিয়ম। এই নিয়ম থেকে ব্যত্যয় যে ঘটে না তা বলছি না। কিন্তু মানুষের অগ্রসরমাণ চেতনাকে দমিয়ে রাখা যায় না। উচিতও নয়।
একটি দেশে দু’ চার শ’ দুর্নীতিবাজ নেতা নির্বাচন করতে না পারলে সে দেশের রাজনীতি থমকে থাকার কথা নয়। কারণ প্রতিটি দেশের বিভিন্ন রাজনৈতিক বলয় থাকে। সামনের সারিটি ব্যর্থতার জন্য কুপোকাত হলে পেছনের সারি সামনে চলে আসে এবং দায়িত্ব নেয়। দেশকে এগিয়ে নিয়ে যায়।
বাংলাদেশে নবম জাতীয় সংসদ নির্বাচনকে সামনে রেখে তেমনি নানা মেরুকরণ হচ্ছে। দেড় দু’ শ’ নেতা এমপি পদে প্রতিদ্বëিদ্বতা করতে পারবেন না বলে সংবাদ বেরুচ্ছে পত্রপত্রিকায়। কেন তারা নির্বাচনের মাঠে খেলোয়াড় হতে পারবেন না তা কারও অজানা নয়। এরা হয়তো দণ্ডিত। না হয় মামলার সম্মুখীন। দেশের নির্বাচনী আচরণবিধিকে সম্মান করলে তাদের উচিত নিজে থেকেই সরে দাঁড়ানো; কিন্তু তারা তা হয়তো করবেন না। তাই বাধ্য হয়েই তাদের অকার্যকর করে দেয়ার কথাটি আসছে।
কথা হচ্ছে যারা দুর্নীতিবাজ বলে প্রমাণিত তারা আবার জনপ্রতিনিধি হতে যাবেন কেন? তারা তা হতে চান নিজেদের স্বার্থ হাসিলের জন্য। এ জন্য তারা মরিয়া। মারমুখো হয়ে নানা ধরনের জঘন্য আচরণ করছেন প্রকাশ্যে। টিভিতে একটি সচিত্র প্রতিবেদন দেখলাম। বিএনপির সাবেক সাংসদ নাসির উদ্দিন পিন্টু একজন জেল পরিদর্শকের ওপর চড়াও হয়েছেন।
নাছির আহমেদ নামক এই পুলিশ অফিসার প্রকাশ্যে সাংবাদিকদের জানিয়েছেন, পিন্টু তাকে ঘুষি মেরেছেন। কি বর্বর আচরণ। কি জঘন্য হীনম্মন্যতা। জেলে থেকে যে রাজনীতিক এমন আচরণ করতে পারছে বেরিয়ে এলে তার আচরণ কেমন হবে? এ রকম নেতাই আজ বিএনপি থেকে ভোটে দাঁড়াতে চায়। এরাই হতে চায় এই দেশ এই জাতির ভবিষ্যৎ রক্ষক? এমন নানা কঠিন এবং জটিল প্রশ্নগুলো নিয়ে এগিয়ে যাচ্ছে দেশ। দেশের একটি প্রধান দল বিএনপি খাবি খাচ্ছে তাদের নিজেদের তৈরি জলাশয়ে। কারণ তারা এমন কাউকেই বিশ্বাস করতে পারছে না। যে দানবতন্ত্র বিএনপি প্রতিষ্ঠা করেছিল সেসব দানব এখন দলছুট। কেউ বিদেশে, কেউ পলাতক, কেউ জেলে, কেউ গণবিচ্ছিন্ন। এসব রাষ্ট্ররক্ষক নামের দানবরা জেলে থেকেই যে কতটা ভয়ঙ্কর সেটাই প্রমাণ করেছে পিন্টু নামের সাবেক সাংসদ।
বিএনপি আসলে কি চাইছে? তারা কি চাইছে তাদের সেই পরিকল্পিত নির্বাচন? যদি তা না হতো তবে তারা একের পর এক দাবি দিয়ে মাঠ ঘোলা করার চেষ্টা করছে কেন? তাদের দাবি মেনে মনোনয়নের মেয়াদ বাড়ানোর পরও খন্দকার দেলোয়ার ‘সাজানো’ পাতানো নির্বাচনের গ খুঁজে বেড়াচ্ছে কেন?
বিএনপির সন্দেহকে পাকাপোক্ত করা হয়েছে শেখ হাসিনার ১৮ ডিসেম্বরের নির্বাচনের জোর দাবির মাধ্যমে। শেখ হাসিনা কিছুটা বেশি আগে বেড়ে এমন দাবির সীলমোহরটি না মারলেও পারতেন। কেউ না এলেও আওয়ামী লীগ নির্বাচনে যাবে কিংবা ১৮ ডিসেম্বর নির্বাচন হতেই হবে এমন দৃঢ় দাবির মাধ্যমে শেখ হাসিনা অদ�রদর্শিতার পরিচয় দিয়েছেন বলেই আমি মনে করি। কারণ এটা ধ্রুব সত্য, কেয়ারটেকার সরকার তাদের হিসেব না মিললে সহজে নির্বাচন দেবে না। আর বিএনপিবিহীন নির্বাচিত সরকারের মেয়াদ হবে ক্ষণস্খায়ী। তাই বিএনপিকে নিয়েই নির্বাচন করতে আগ্রহী সরকার। এ ক্ষেত্রে শেখ হাসিনার উচিত ছিল, পরিস্খিতি গভীর পর্যবেক্ষণ করে বরং নিজের দলও জোটকে আরও সংগঠিত করা। তা না করে শেখ হাসিনা তদারকি সরকারের এজেন্ডা বাস্তবায়নে কেন অগ্রণী হতে চাইলেন তা বোধগম্য নয় কোন মতেই।
দুই.
নির্বাচন যতই ঘনিয়ে আসছে ততই নতুন নতুন যোগ-বিয়োগ লক্ষ্য করছি আমরা। জামিন না দিয়ে নিজামী, মুজাহিদ সাইফুর রহমানকে জেলে পাঠানো হয়েছে। লক্ষ্য হচ্ছে এদের নির্বাচন থেকে বিরত রাখা। তারা আবার জামিনে বেরিয়ে আসবেন কিংবা সহজেই জামিন পাবেন ঘটনাবলীর চলমানতা আপাতত সে সাক্ষীই দিচ্ছে। এদিকে ড. কামাল, বি চৌধুরী, কাদের সিদ্দিকীরা নতুন ফ্রন্ট গঠনের ডাক দিয়েছেন। প্রশ্ন হচ্ছে, তাদের প্রস্তাবিত ফ্রন্টের সব দল মিলিয়ে দেশে তাদের জনপ্রিয়তা কত শতাংশ? প্রত্যন্ত অঞ্চলে এখনও এমন জেলা আছে যেসব জেলার মানুষ বিকল্প ধারা, গণফোরাম কিংবা কল্যাণ পার্টির নামও জানে না। তা হলে তো সংস্কারের নামে এসব ফন্সন্টবাদীরা বরং ডানপন্থী মোর্চার পারপাসটাই সার্ভ করছেন। যোগ্য প্রার্থী দেয়ার নামে কিছু ভোট কেটে নিয়ে ডানপন্থী জাতীয়তাবাদীদের বিজয়ের পথ প্রশস্ত করে দিচ্ছেন। তারা সমমনা বড় দলের মোর্চায় যোগ দিয়েই বরং এই ক্রান্তিকালের নির্বাচনটি পার হতে পারতেন। তারা তা করছেন না। যা জাতির জন্য মোটেই কল্যাণকর নয় এ মুহ�র্তে।
দুদক চেয়ারম্যান হাসান মশহুদ চৌধুরী বলেছেন, জামিন পাওয়া আর মামলা থেকে অব্যাহতি এক কথা নয়। দুদক চেয়ারম্যান আশা প্রকাশ করে বলেছেন, তারা আসামিদের প্রমাণপত্র সাপেক্ষে সুবিচারের মুখোমুখি করতে পারবেন। কিন্তু আমরা দেখছি প্রধান দুই নেত্রীকে প্রায় সবক’টি মামলা থেকেই ক্রমশ অব্যাহতি দেয়া হচ্ছে। তাহলে বাকিদের ব্যাপারে কি হবে? তা দেখার জন্য আরও কিছুদিন অপেক্ষা করতে হবে মাত্র।
দেশের বিশিষ্ট অর্থনীতিবিদ ড. আবুল বারকাত নিউইয়র্কে বলেছেন, ওয়ান ইলেভেন মূলত ছিল আমাদের কোমর ভেঙে দেয়ার একটি প্রচেষ্টা। হঠাৎ করে সবকিছু তছনছ করে দিয়ে রাজনীতি স্খবির করে দেয়া মাত্র। কার্যত সেটাই পরিলক্ষিত হচ্ছে। এবং এর রেশ ধরে নির্বাচন হবে কি না তা নিয়েও সংশয়ে ভুগছে দেশবাসী। মানুষ এটাও লক্ষ্য করছে, ব্যারাকঘেঁষা এক শ্রেণীর মুখপাত্র সাংবাদিক ইতোমধ্যে নির্বাচন পিছিয়ে দেয়ার ‘খোলা সুপারিশ নামা’ও পেশ করতে শুরু করেছেন। তা হলে কি এই ক্রান্তিকাল দীর্ঘ করার কোন গোপন ইচ্ছে কোথাও লালিত হচ্ছে?
দেশের অর্থনৈতিক সমৃদ্ধির জন্য গণতন্ত্র প্রয়োজন। দেশের প্রজন্মকে বাড়িয়ে তোলার জন্য গণতান্ত্রিক সরকার প্রয়োজন। জরুরি আইন কখনই কোন রাষ্ট্রে স্খায়ী সমাধান দেয় না, দিতে পারে না। জরুরি আইন গণবিচ্ছিন্ন রাষ্ট্ররক্ষকদের মানুষের কাছে চিহ্নিত করে যায়। আর মানুষ তা থেকে নতুন নেতৃত্ব নির্বাচন করতে শেখে।
নিউইয়র্ক ১১, নভেম্বর ২০০৮
---------------------------------------------------------------------------------
দৈনিক সংবাদ । ১৪ সেপ্টম্বর ২০০৮ শুক্রবার প্রকাশিত

Saturday, March 8, 2008

বিবর্তন, বৈষম্য ও সৃজনশীলতার পূর্বশর্ত


বিবর্তন, বৈষম্য ও সৃজনশীলতার পূর্বশর্ত

ফকির ইলিয়াস

=================================

রক্ষণশীল সমাজ ব্যবস্থা প্রাচ্য কিংবা পাশ্চাত্যের সব দেশেই আছে। একটি সমাজ নির্মাণে সে সমাজের মানুষের পরিশুদ্ধ অংশগ্রহণই নিশ্চিত করে ভবিষ্যৎ প্রজন্মের জন্য সুন্দর দিন। আর সে অংশগ্রহণ কিন্তু নারী এবং পুরুষের সমান ভাবেই হতে হয়। এমন এক সময় ছিল, যখন নারীশিশু জন্ম নিলে তাকে জীবন্ত পুঁতে রাখার আদিমতা ছিল সামজে। অথচ মানুষ সে সময়ও ছিল বিবর্তনবাদী। প্রশ্ন হচ্ছে মানুষ যদি সভ্যতা সুন্দর এবং সত্যের স্বপক্ষে বিবর্তনবাদীই হবে, তবে মাঝেমাঝে এখনো আদিমতা গ্রহণ করবে কেন?আমরা কতগুলো উদাহরণ দেখি এখনো প্রাচ্যের সমাজে। পুরুষতান্ত্রিক শক্তির ব্যবহার কখনো কখনো আমাদের ভুলিয়ে দেয়, এ সমাজে নারী নামের আরেকটি লিঙ্গের মানুষ আছে। শাসনের বিভিন্ন জাঁতাকলে আছে। এগুলোর মধ্যে রাষ্ট্রীয়, তত্ত্বীয়, ধর্মীয় এবং সামাজিক শাসনগুলোই প্রধান। আমরা দেখব যারা ফতোয়া দিয়ে বেড়ান, তারা কিন্তু ফতোয়াগুলোর নিরানব্বই ভাগই জারি করেন নারীদের বিরুদ্ধে। পুরুষের বিরুদ্ধে ফতোয়া জারি করে তাকে বড়জোর একঘরে করে রাখা যায় কয়েকমাস। তারপর সে আবার সমাজে উঠে আসে। কোনো পুরুষকে দোররা মারার ঘটনা আমরা কখনো শুনিনি। অথচ নারীকে দোররা মেরে মাটিতে পুঁতে হত্যা করার মর্মান্তিক ঘটনাও আমরা দেখেছি। ধর্ম এবং সমাজের মিশ্রণে এই যে পেশিশক্তির দাপট তা একটি শুদ্ধ প্রজন্মের ভবিষ্যৎ নির্মাণে হুমকি বৈকি!যেসব নারী গণিকাবৃত্তি করে তাদের সমাজ পতিতা বলে আখ্যায়িত করে খুব সহজে। প্রাচ্যে এবং পাশ্চাত্যে এই আখ্যায়ন চলছে এখনো। কিন্তু যে পুরুষ গণিকালয়ে যায় তাকে ‘পতিত বলে’ সমাজ আখ্যা দেয় না। দিতে পারে না। কেন পারে না? এতে বাধা কোথায়?আজ থেকে তিন দশক আগেও মধ্যপ্রাচ্যের মুসলিম দেশগুলোর নারীদের কর্মসংস্থান বিষয়ে নানা অলিখিত নিষেধাজ্ঞা ছিল। তা এখন ক্রমশ সরতে শুরু করেছে। মধ্যপ্রাচ্যের সরকারি দফতর, ব্যাংক বীমা, হাসপাতাল, ডাকঘরসহ অনেক সরকারি বেসরকারি অফিস, প্রতিষ্ঠানে এখন নারীদের কর্মসংস্থানের দ্বার উন্মুক্ত হয়েছে। আর তা সম্ভব হয়েছে সামাজিক ধ্যানি-চেতনার কারণেই। সামাজিক লিঙ্গ বৈষম্যের বিভিন্ন ধাপ আমরা বিশ্বের বিভিন্ন দেশে লক্ষ্য করি। ইসলাম ধর্মে এক ছেলে সন্তানের সমান পরিমাণ মালামাল দু’মেয়ে সন্তান পাবে এমন একটি রেওয়াজ ছিল। তা বিভিন্ন দেশে এখন সংস্কার করা হয়েছে। একটি মেয়ের যদি একটি ভোট হয়, একটি ছেলেরও তেমনি একটি ভোট। তাহলে রাষ্ট্রে পৈতৃক মালামাল, সম্পত্তি পেতে বৈষম্য হবে কেন? বলা যায় বিয়ের প্রথার কথাও। একজন পুরুষ একসঙ্গে চারজন স্ত্রী রাখতে পারবে। কিন্তু একজন নারী একসঙ্গে একাধিক স্বামী রাখতে পারবে না। এই যে স্বীকৃত প্রথা ইসলাম ধর্মে রয়েছে, এর সহজ কোনো সমাধান আপাত দৃষ্টিতে নেই। যদি সামাজিকভাবে মানুষ তা গ্রহণ কিংবা বর্জনে রাজি না হয়।দুই. বিতর্কিত অনেক প্রথা অনেক ধর্মেই আছে। হিন্দু ধর্মে সতীদাহ, অকাল বৈধব্যের পর আর বিয়ে না করা প্রভৃতি কার্যক্রম কোনো সভ্য সমাজেই গৃহীত হতে পারে না। যারা কট্টরপন্থী জুইশ (ইহুদি) ধর্মাবলম্বী, সে সমাজের নারীদের বিয়ের পরই তাদের চুল কেটে ফেলতে হয়। তারপর তাদের পরচুলা ব্যবহার করতে হয়। স্বামীর মনোরঞ্জন ছাড়া অন্য কোনো পুরুষের যাতে দৃষ্টি কাড়তে না পারে সেজন্য হাইহিল জুতা, টাইট ফিটিংস কাপড়চোপড় তারা পরতে পারে না। এমনকি প্রচলিত আছে, জুইশ ধর্মাবলম্বী কট্টরপন্থী পুরুষরা তাদের স্ত্রীকে সন্তান ধারণে বাধ্য করে অনেকটা বলপূর্বক। অনেকটা ইচ্ছার বিরুদ্ধেই।ইউরোপ-আমেরিকার জুইশ ধর্মাবলম্বী কট্টরপন্থীরা তাদের ছেলেমেয়েদের বিয়ে শাদীর ব্যাপারেও পরিবারের অগ্রজদের মতামতকে চাপিয়ে দেয়। অ্যারেঞ্জড কিংবা সেটেলম্যারেজ প্রথা শুধু বাঙালি সমাজ ব্যবস্থায় নয়, আইরিশ, ইতালিয়ান, গ্রিক, জুইশ, রাশিয়ান সমাজেও আমরা প্রত্যক্ষ করি। আর এসব সমাজের দাম্পত্য জীবনে শান্তি এবং অশান্তি দুটোই কিন্তু থেকে যাচ্ছে সমানভাবে। এসব দায় থেকে মুক্তির একমাত্র পথ হচ্ছে সমঝোতাপূর্ণ জীবনযাপন। তা যে কোনো দেশে যে কোনো সমাজেই হোক।লিঙ্গের সমঅধিকার প্রতিষ্ঠার একমাত্র পূর্বশর্ত হচ্ছে আইনের শাসন। গেল কিছুদিন আগে যুক্তরাষ্ট্রের নিউজার্সি অঙ্গরাজ্যের একটি ঘটনা এখানে উল্লেখ করা যেতে পারে। এক দম্পতি ডিভোর্স চেয়ে পারিবারিক আদালতের শরণাপন্ন হয়েছিল। এ সময়ে স্বামী স্টেট লটারিতে পাঁচ মিলিয়ন ডলার জিতে যায়। স্ত্রী আইনানুযায়ী তার অর্ধেক দাবি করে। স্বামী বলে আমরা ডিভোর্স ফাইল যেহেতু করেছি, তাই স্ত্রী অর্ধেক অর্থমূল্য পাবে না। কিন্তু আইনি মারপ্যাঁচে হেরে যায় স্বামী। মাননীয় আদালত রায় দেন যেহেতু ডিভোর্স প্রক্রিয়াটি এখনো সম্পন্ন হয়নি তাই স্ত্রী লটারির অর্ধেক অর্থমূল্যের ভাগীদার। একটি রাষ্ট্রে সুষ্ঠু আইনি বিচার এবং সততা থাকলেই সমঅধিকারের বিষয়টি পূর্ণতায় রূপ নেয়া সহজ হতে পারে।আবারও ধরা যাক বাংলাদেশের মহান মুক্তি সংগ্রামের কথা। এই স্বাধীনতা সংগ্রামে নারীদের যে স্বর্ণোজ্জ্বল অবদান, তা কি সরকারিভাবে ব্যাপক স্বীকৃত হয়েছে? না, হয়নি। এমনকি যারা বীরাঙ্গনা, যারা তাদের মহামূল্যবান সম্ভ্রম হারিয়ে ছিলেন আমাদের বিজয়ের জন্য তাদের কিন্তু প্রচলিত সমাজ ব্যবস্থা যথার্থ সম্মান দেয়নি। কেন দেয়া হয়নি? কেন এই দীনতা!ব্যক্তিস্বাধীনতা কিংবা আধুনিকতা মানুষের মৌলিক অধিকার। কিন্তু আধুনিকতার লেবাসে উগ্রতা, বেহিসেবীপনা কোনো সমাজই গ্রহণ করে না। যেসব কর্ম সমাজ কিংবা প্রজন্মকে ধ্বংস করে দিতে পারে তাকে তো আর ব্যক্তিস্বাধীনতা বলা যায় না। লক্ষ্য করলে দেখা যাবে ইউরোপের কিছু কিছু দেশে যৌন উগ্রতার নামে মানব সভ্যতাকে ধ্বংসের কর্মকা- পরিচালনা করা হচ্ছে। যেমন অবৈধ মাদক দ্রব্যের বিক্রি লাইসেন্স নিয়ে ইউরোপের কোনো কোনো দেশে আইনি দেনদরবার চলছে। মাদক দ্রব্য গোটা মানব জাতির জন্যই মারাত্মক ক্ষতিকর। সে নারী কিংবা পুরুষ হোক।সমান অধিকারকামী সমাজ প্রতিষ্ঠার অন্যতম শর্ত হচ্ছে একটি রাষ্ট্রে আইনের শাসন প্রতিষ্ঠা, যা নারী-পুরুষের অধিকারের নিরাপত্তা, নিশ্চয়তা দেবে। মানুষ মানুষের হাতে নিগৃহীত হবে না। মানুষ মানুষের কাছে প্রতারিত হবে না। তারপরের শর্তটি হচ্ছে সুশিক্ষায় শিক্ষিত করে তোলা। মনে রাখতে হবে সৃজনশীল বিবর্তনই মানুষকে এ জন্য সাহায্য করেছে। এর পাশাপাশি পারস্পরিক শ্রদ্ধাবোধ, সহনশীলতাই হতে পারে সমাজ নির্মাণের মূলমন্ত্র।

---*************-------------------দৈনিক ডেসটিনি।ঢাকা।৯মার্চ ২০০৮ রোববার প্রকাশিত

Tuesday, March 4, 2008

সুবিচার যখন প্রধান নাগরিক প্রত্যাশা


সুবিচার যখন প্রধান নাগরিক প্রত্যাশা

ফকির ইলিয়াস

================================

দুর্নীতির অভিযোগে ফেঁসে যেতে পারেন নিউইয়র্কের সাবেক পুলিশ কমিশনার বার্নার্ড কেরিক। তার বিরুদ্ধে মারাত্মক অভিযোগ উত্থাপিত হয়েছে। ইন্টারনাল রেভিন্যু সার্ভিস (আইআরএস) বলেছে, তার আয়ের সঙ্গে ট্যাক্স প্রদানের সঙ্গতি নেই। এসব অর্থ কী করে অবৈধভাবে অর্জন করা হয়েছে? এমন অনেক প্রশু এখন মুখে মুখে। যদি তিনি দোষী সাব্যস্ত হন তবে যাবজ্জীবন কারাভোগ করতে হতে পারে। ইউএস অ্যাটর্নি বলেছেন, তিনি পুলিশের চিফ ছিলেন। সেই ব্যক্তিই যদি এমন দুর্নীতিগ্রস্ত প্রমাণিত হন তবে আইন প্রয়োগকারী সংস্থার প্রতিই মানুষ বিশ্বাস হারাবে। বার্নার্ড কেরিক নিউইয়র্কের সাবেক মেয়র জুলিয়ানির ঘনিষ্ঠ জন। নাইন-ইলেভেনের সময়ও তিনিই ছিলেন পুলিশ কমিশনার। পরবর্তী সময়ে অবসরে যাওয়ার পর হোমল্যান্ড সিকিউরিটি মন্ত্রণালয়ের প্রধান অর্থাৎ সেত্রেক্রটারি অব হোমল্যান্ড সিকিউরিটি হিসেবেও কেরিকের নাম প্রস্তাব করা হয়েছিল। সে সময়ই তার বিরুদ্ধে বিস্তর দুর্নীতির অভিযোগ আসে। বার্নার্ড কেরিক তার নাম প্রত্যাখ্যান করে নেন। কিন্তু তদন্ত তার পিছু ছাড়েনি। সেসবের অংশ হিসেবেই এখন তিনি দোষী সাব্যস্ত হওয়ার পথে। মামলার রায়, আপিল শুনানি সবকিছুর আইনি প্রত্রিক্রয়া সমাপ্ত হলে রায় তার অনুকূলে যাওয়ার কোনো সম্ভাবনা আপাতত নেই।বার্নার্ড কেরিকের নাম বাদ পড়ার পরই মাইকেল শের্টফকে প্রেসিডেন্ট বুশ হোমল্যান্ড সিকিউরিটির প্রধান হিসেবে নিয়োগ প্রদান করেন। যিনি এখনো এই পদে বহাল আছেন। এদিকে কেরিকও একজন সুপরিচিত রিপাবলিকান ধনপতি। পুলিশের চাকরি ছেড়ে দেওয়ার পর নিজের ব্যবসা-বাণিজ্য নিয়ে ব্যস্ত ছিলেন। কিন্তু পুলিশ কমিশনার হিসেবে তিনি কি অবৈধভাবে আয় করেছেন? এসব প্রমাণের জন্যই সরকার পক্ষ এখন নেমেছে কোমর বেঁধে। এই যে আইনি প্রক্রিয়া তা সবার জন্যই সমান থাকা বাঞ্ছনীয়। এর আগে ইন্টারনাল রেভিন্যু সার্ভিসের প্রধান রক্ষক অ্যালেন হ্যাভেসির বিরুদ্ধেও এ রকম অভিযোগ এসেছিল। তিনি তার ক্ষমতার অপব্যবহার করেছেন। অপরাধ শাস্তিযোগ্য হওয়ায় তাকেও শাস্তি পেতে হচ্ছে। এই যে ঘটনাবলি তা শুনে কেউ কেউ হয়তো বলবেন, যুক্তরাষ্ট্রে তো দুর্নীতি আরো অনেক হচ্ছে। সব দুর্নীতির বিচার হচ্ছে কি? বিচার যে হচ্ছে না তা কিন্তু নয়। দু’চারজন রাঘববোয়ালকে কাঠগড়ায় দাঁড় করানোর মাধ্যমে যু্ক্তরাষ্ট্রের বিচার বিভাগ এই বিশ্বাস স্থাপনে সমর্থ হয়েছে যে, মানুষের আস্থা নিয়েই চলেছে স্বাধীন বিচার বিভাগ। বাংলাদেশেও সদ্য স্বাধীন বিচার বিভাগ যাত্রা শুরু করেছে। অনেক চড়াই-উতরাই পেরিয়ে এই যাত্রা শুরুকে স্বাগত জানাতেই হবে। প্রশ্ন আসতেই পারে, এরপর মানুষ সুবিচার কিংবা দ্রুত বিচার পাবে কি-না। কিংবা মানুষের পক্ষে ন্যায়বিচার সুপ্রতিষ্ঠিত হবে কি-না। বিচার বিভাগের স্বাধীনতার সঙ্গে গ্র্যান্ড জুরিদের মতামতের প্রতিফলন ঘটানোটাও জরুরি বলে আমি মনে করি। উন্নত গণতান্ত্রিক বিশ্বে জুরি ব্যবস্তা ক্রমশ প্রাধান্য পাচ্ছে। এতে নাগরিক দায়িত্ব যেমন প্রতিষ্ঠিত হয় তেমনি হয় ভারসাম্য রক্ষা করে সুবিচার প্রতিষ্ঠা। এ প্রসঙ্গে আরেকটি কথা না বললেই নয়। তা হচ্ছে, বাংলাদেশে জমি-জিরাত সম্পর্কিত দেওয়ানি মামলাগুলোর কথা। আমরা দেখেছি, বাংলাদেশে এসব দেওয়ানি মামলা যুগের পর যুগ আদালতে চলতেই থাকে। একটি মামলাকে ‘দাদা-বাপ-পুত্র’ এ রকম তিন পুরুষও চালিয়ে গেছেন কিন্তু মামলার সুরাহা হয়নি এমন নজিরও আমরা দেখেছি। বাংলাদেশের আইনে ফৌজদারি মামলা যতটা গুরুত্ব পায়, দেওয়ানি মামলাগুলো এর চেয়ে কম গুরুত্ব পেয়ে থাকে। এ অবস্থার দ্রুত পরিবর্তন প্রয়োজন। কারণ, যিনি বিচারপ্রার্থী তিনি সমস্যাটির সমাধান এবং দ্র“ত সুবিচার পাওয়ার জন্যই আইনের আশ্রয় নেন। এক্ষেত্রে তা ঝুলে থাকবে কেন? কেন কালক্ষেপণ একজন নাগরিককে রাখবে মানসিক অশান্তিতে।যুক্তরাষ্ট্রের প্রেক্ষাপটে বলা যায়, এখানে জমিজমা, রিয়েল এস্টেট সম্পর্কিত মামলাগুলো সিভিল ল’র অধীনে গুরুত্বের সঙ্গেই বিবেচিত হয়। বরং অবৈধভাবে দখলদার কেউ ত্রিক্রমিনাল অ্যাক্টে দোষী সাব্যস্ত হতে পারে। ওয়ান-ইলেভেনের পর আমরা ইদানীং একটি কথা প্রায়ই শুনি। তা হচ্ছে সবাই-ই যদি দোষী হয়ে গেল তবে বাংলাদেশে নীতিবান রাজনীতিক ও ব্যবসায়ী কারা? আমার মনে হয়, এ প্রশু যারা তোলেন তারা শাক দিয়ে মাছ ঢাকতে চান। তাহলে কি আমরা ধরে নেব ১৪ কোটি মানু্ষের রাষ্ট্রে কোনো নীতিবান নেই? অবশ্যই আছেন। আর আছেন বলেই এই প্রজন্ম সোনালি সূর্যের স্বপ্ন দেখে। এখনো মানুষ প্রত্যয় নিয়ে বলে, মুক্তিযুদ্ধ আমাদের অহংকার। অন্যায়ের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়ায় মানুষ। লক্ষণীয় বিষয় হচ্ছে, দুর্নীতিতে বাংলাদেশ বারবার চ্যা¤িক্সয়ন হওয়ার পরও দেশের শাসকশ্রেণী বিষয়টিকে মোটেও গুরুত্ব দেয়নি। দখলের মাত্রা এত চরমে পৌঁছেছিল, এক সময় এই রাষ্ট্রটিকেই কেউ কেউ নিজেদের নামে লিখিয়ে নেয় কি-না তা নিয়ে শংকা দেখা দিয়েছিল। রাস্তা বন্ধ করে যারা ক্রিকেট খেলে উল্লাস নৃত্য করেছিল, কিংবা যারা ট্রাক তুলে দিয়েছিল গণমানুষের ওপর এরা কোন শ্রেণীর মানসিকতা পোষণ করতো তা দিনে দিনে অনেক খোলসা হয়েছে। জরুরি কথা একটাই, রাষ্ট্রে যদি সুবিচার প্রতিষ্ঠিত হয় তবেই দুর্নীতি সিংহভাগ কমে যেতে বাধ্য। আর তা হতে হবে যে কোনো রাজনৈতিক স্বার্থের ঊর্ধ্বে থেকে। পৃথিবীর দেশে দেশে জুলুমকারী জালেমরা আছে। কিন্তু বিশ্বের আপামর মানুষই শান্তিকামী। অধিকাংশ মানুষই দুর্নীতির বিরুদ্ধে সোচ্চার। তা প্রমাণিত হয়েছে, এখনো হচ্ছে দেশে দেশে, যুগে যুগে।-------------------------------------------------------------------------------দৈনিক সমকাল। ঢাকা। ৪ মার্চ ২০০৮ মংগলবার প্রকাশিত

Saturday, February 23, 2008

দাগচিহ্ন


দাগচিহ্ণ

ফকির ইলিয়াস

============

তোমার জন্য কিছু চিহ্ন রেখে যাবো। দাগগুলো আমারই

থাক,এমন ধুসর শরীরে মাটির মমি হয়ে যেমন ঘুমিয়ে

থাকে , পুরনো কাঠের শিকড় ,পচে যাওয়া পাতাবৃক্ষ কিংবা

গোলাপের পাপড়িপ্রদেশ। রেখে যাবো আঁকন আর কাঁপনের


আঁচড়। চর, নৃ-নদী। দাগগুলো শুকিয়ে যায়। চিহ্ণ শুকায় না

কখনো।দাগগুলো ঢেকে রাখে মানুষ। চিহ্নগুলো অন্য কাউকে

দেখিয়ে বলে, এই দ্যখো আমার গরিমা,

দাগের অন্ত:সত্তা মেঘ, চিহ্ণের প্রথম প্রতিমা।

Friday, February 22, 2008

ভাষার প্রতিপত্তি, বিশ্বায়নের সমকাল


ভাষার প্রতিপত্তি, বিশ্বায়নের সমকাল

ফকির ইলিয়াস

---------------------------------
একটি ভাষা যে কোন জাতির কাছেই সমাদৃত। সে ভাষার জনগোষ্ঠী যত বড় কিংবা যত ছোটই হোক। যুক্তরাষ্ট্রের একজন বিশিষ্ট ভাষাবিজ্ঞানী ড. জেভিন বেকন বলেন, একটি ভাষা হচ্ছে একটি জাতির মুখ্যশক্তি। ভাষা মানুষের প্রথম এবং শেষ আশ্রয়। কারণ জন্ম নিয়েই সে নিজ মায়ের ভাষায়, মায়ের আদর স্নেহ পায়। আবার মৃত্যুর সময় নিজ মাতৃভাষায়ই শেষ আরাধনাটুকু করে যায়।আজকের বিশ্বে সে ভাষাই তত বেশি শক্তিশালী, যে ভাষার যে রাষ্ট্রের অর্থনীতি যত বেশি চাঙ্গা­ তা অস্বীকার করার কোন উপায় নেই। তার কারণ কি? কারণ হচ্ছে শক্তিশালী ভাষাভাষি মানুষরাই বিশ্ব নিয়ন্ত্রণ করছে। অগ্রসরমাণ প্রজন্মের শক্তি সঞ্চিত হলেই স্বীকৃতি মিলছে নিজ ভাষার। যুক্তরাষ্ট্রের নিউইয়র্ক শহরের প্রধান প্রধান হাসপাতালে সাইন বোর্ড ঝুলছে, ‘আমরা বাংলায় কথা বলি’। নিউইয়র্কের বোর্ড অফ এডুকেশন তাদের প্রতিটি নোটিশে এখন সংযোজন করে নিয়েছে বাংলাভাষা। নির্দেশিকায় স্খান পাচ্ছে বাংলায় নিয়মাবলি। তার কারণ প্রায় পনেরো হাজারেরও বেশি বাংলা ভাষাভাষি ছাত্রছাত্রী এখন লেখাপড়া করছে নিউইয়র্কের মাধ্যমিক-উচ্চমাধ্যমিক বিদ্যালয়গুলোতে। এখন এখানে ‘বাংলা কারিকুলাম’ চালু করে বাংলা ভাষা ও সাহিত্য শিক্ষার প্রচেষ্টা চলছে।বিশ্বে একই রাষ্ট্রে বিভিন্ন ভাষা চালু থাকার উদাহরণও দেখি আমরা। ভারতের কথাই ধরা যাক। কেরালা কিংবা তামিলনাড়ু অঙ্গরাজ্যের মাতৃভাষা আর কোলকাতার মাতৃভাষা এক নয়। দুটি রাজ্যের দু’জন নাগরিকের রাষ্ট্রভাষা যদিও ‘হিন্দি’ কিন্তু এই দুই অঙ্গরাজ্যে তা কি মানতে দেখা যায়? না, যায় না। বরং এই দু’অঙ্গরাজ্যের নাগরিকার মিলিত হয়ে যান এক ভাষায়। আর তা হচ্ছে ইংরেজি। ইউরোপ-আমেরিকার বিভিন্ন মাল্টিকালচারাল কোম্পানি তাদের শোরুম খুলেছে মুম্বাই, দিল্লি, পুনা কিংবা কেরালার ট্রিচুর ডিস্ট্রিক্টে। সেখানে ভারতীয় রিপ্রেজেনটেটিভদের বলা হয়েছে, ফোনের জবাব দিতে হবে ইংরেজিতে। কারণ ক্লায়েন্ট সবাই ইউরোপ-আমেরিকার। ভাষার প্রতিপত্তি এভাবেই দখল করে নিয়েছে বিভিন্ন উপনিবেশ। অর্থনীতিই হয়ে ওঠেছে মুখ্যশক্তি। এমনকি বদলে দেয়া হয়েছে সেখানকার প্রতিনিধিদের নামও। ‘রাজেশ’ হয়ে গিয়েছে ‘রেন্ডি’, ‘মনিষা’ হয়ে গিয়েছে ‘মনিকা’। এ বদল শুধু প্রতীকী কারণের। এই সঙ্গে জড়িত ‘মাল্টিকমপ্লেক্স বিজনেস অ্যান্ড মার্কেটিং।’বিভিন্ন দেশেই আজ একটি বিষয় লক্ষ্য করা যায়, তা হচ্ছে শুদ্ধ এবং কথ্যভাষার দ্বন্দ্ব। যুক্তরাষ্ট্রে আঞ্চলিক কিংবা কথ্যভাষায় বিভিন্ন রেপ সঙ্গীতে এমনভাবে বাণীবদ্ধ করা হয়, যার মাঝে মধ্যে অশ্লীল, অশোভন কিছু শব্দও ঢুকিয়ে দেয়া হয় খুব কৌশলে। এসব গান পারিবারিক আবহে, মাতা-পিতা-স্ত্রী-পুত্র-কন্যা নিয়ে বসে শোনার মতোই নয় বলা যায়। তারপরও এসব রেপ সঙ্গীতের সিডি বাজারে আসছে মিলিয়ন মিলিয়ন। এরও কারণ একটাই, বাণিজ্যিক মুনাফা অর্জন এবং তা সম্ভবও হচ্ছে।দুই.কবি অক্টাভিওপাজ এক সাক্ষাৎকারে বলেছিলেন, ‘আমি লিখি আমার মাতৃভাষায়। বাজারজাতকারীরা তা ইংরেজিতে তর্জমা করে মুনাফা লুটে। নোবেল কমিটির কাছেও ইংরেজি ভাষার গুরুত্ব বেশি। তা না হলে তারা ইংরেজি ছাড়া অন্য ভাষায় প্রতিষ্ঠিত কবি-লেখকদের ব্যাপারে অন্তিমে এসে আগ্রহী হবে কেন?’পাজের ক্ষোভ বাজারি মুনাফাখোরদের প্রতি। কিন্তু সে ক্ষোভ যতই তীব্র হোক না কেন, ভাষা বাণিজ্যকারীরাই পৃষ্ঠপোষকতা পায় বিভিন্ন সরকারের, রাষ্ট্র শাসকদের। এই মুনাফালাভের লোভ তো লেখকরাও সংবরণ করতে পারেন না!বাংলাভাষা ও সাহিত্যের আলোকে একটি সাম্প্রতিক উদাহরণ দেই। কোলকাতার খ্যাতিমান লেখক দেবেশ রায় সম্প্রতি বাংলাদেশ সফর করে গেছেন। তিনি বাংলাদেশের কথাসাহিত্য নিয়ে একটি পর্যবেক্ষণ করেছেন। তার নিজের ভাষায় তা হচ্ছে তার ‘আন্দাজ’। কোন আন্দাজ নিশ্চয়ই কোন রাষ্ট্রের সাহিত্যকে নির্ধারণ করতে পারে না। তা নিয়ামক তো নয়ই। এদিকে বাংলাদেশেও কিছু লেখক-কবি আছেন যারা মুহুর্মুহু কোলকাতা, পশ্চিমবঙ্গের সাহিত্যের তীব্র বিরূপ সমালোচনা করে থাকেন। তারা তাদের ভাষায় ‘ইনডিয়া’র বাংলা বইয়ের বাংলাদেশে আগমনেরও ঘোরবিরোধী। কিন্তু বড় অবাক হয়ে দেখলাম ওই ‘আন্দাজ’ পর্বের লেখায় যাদের নাম আছে­ তাদের ‘ইন্ডিয়া’ বিরোধী বেশ ক’জন ওই লেখাটিকে তাবিজ বানিয়ে গলায় ঝুলাতেও কসুর করছেন না। এর কারণ কি? কারণ হচ্ছে পক্ষান্তরে সাহিত্যের বাজার-বাণিজ্যিকে স্বীকার করে নেয়। তাহলে রাষ্ট্রীয় আলোচনার মাধ্যমে কোলকাতা-ঢাকা যৌথ বইমেলা, সাহিত্য অনুষ্ঠান, ভাষা সংস্কৃতির আদান পর্ব হতে দোষ কোথায়? নাকি সেখানেও কারও কারও স্বার্থের বিষয় জড়িয়ে আছে? সাহিত্য এবং ভাষার বিশ্বায়নের সমকালে তা কি আটকে রাখা যাবে? দোষ যে কোলকাতা রাজ্য সরকারের নেই, তা আমি বলছি না। তারাও ঢাকার বাংলা টিভি চ্যানেলগুলোকে কোলকাতায় ঢুকতে না দিয়ে একক রামরাজত্ব বহাল রাখতে চাইছেন। কিন্তু হালে তা কি সম্ভব হবে? বিবিসি, সিএনএন এর ওয়ার্ল্ড সার্ভিস দখল করে নিয়েছে এবং নিচ্ছে স্যাটেলাইট আকাশ। তাহলে বাংলা ভাষাভাষি দু’ দেশবাসীর এত দ্বিধা কেন?তিন. গেল এক দশক ধরে বাংলাদেশে একটি সাহিত্যকর্ম আমাকে বেশ আপ্লুত করছে। আর তা হচ্ছে বিভিন্ন ক্ষুদ্র জনগোষ্ঠীর ভাষা নিয়ে সংস্কৃতি সাহিত্য নিয়ে আগ্রহ দেখাচ্ছেন রাষ্ট্রের আপামর মানুষ। মণিপুরী, গারো, হাজং, মারমাসহ বিভিন্ন ভাষাভাষি তরুণ সাহিত্যিকরা এগিয়ে এসেছেন। তারা সেসব ভাষার কবিতা, কথাসাহিত্য বাংলায় অনুবাদ করে বাংলা সাহিত্যের মূলধারায় প্রতিষ্ঠিত করছেন। তা অনুমান হচ্ছে এভাবে ইংরেজিতেও। কোন উপজাতির সাহিত্য, একটি রাষ্ট্রের রাষ্ট্রীয় ভাষার বাহু বলা যায়। কারণ সেসব ভাষাভাষি মানুষও একই রাষ্ট্রের প্রাণশক্তি। বলছিলাম, একই রাষ্ট্রে বিভিন্ন আঞ্চলিক ভাষার কথা। কোন অঞ্চলের কথ্য ভাষায় সাহিত্য রচিত হবে কি না; কিংবা হওয়া উচিত কি না তা নিয়েও চলছে নানা বিতর্ক। একটি কথা মনে রাখতে হবে, একই রাষ্ট্রের অভ্যন্তরেই একটি অঞ্চলের কথ্যভাষা অন্য অঞ্চলে সম্পূর্ণ অচল। এমন কিছু শব্দাবলি আছে যা অঞ্চলের ক্ষেত্রবিশেষে ভিন্ন অর্থও প্রকাশ করে। তাহলে সঙ্গত কারণেই প্রশ্ন আসছে যিনি কোন আঞ্চলিক কথ্যভাষায় গদ্য পদ্য লিখছেন, তিনি কি এ অঞ্চলের পাটক-পাঠিকাকে সামনে রেখেই তা লিখছেন। নাকি তার জাতীয় ভাষার পাঠক তার লক্ষ্যবিন্দু। আগেই বলেছি, ইংরেজিতে কথ্য অশ্লীল শব্দ ব্যবহার করে গান রচিত, গীত হচ্ছে পাশ্চাত্য। এর শ্রোতাও একটি গোষ্ঠী। বাজারি চাহিদাও রয়েছে। যুক্তরাষ্ট্রের বিভিন্ন অঙ্গরাজ্যেও ইংরেজি ভাষার বাচনভঙ্গি, উচ্চারণের ভিন্নতা প্রায়ই লক্ষ্য করা যায়। যেমন­ নর্থ ক্যারোলিনা, সাউথ ক্যারোলিনা, টেক্সাস কিংবা নিউইয়র্কের মানুষ একই বাচনভঙ্গিতে কথা বলেন না।সমকালের সঙ্গে তাল মিলিয়ে অগ্রসর হতে যত বেশি সম্ভব ভাষার দখল শিখতে পারাটাই কৃতিত্ব বলে আমি মনে করি। যুক্তরাষ্ট্রে বেড়ে ওঠা কোন বাঙালি প্রজন্ম যদি বাংলাভাষা, সাহিত্য-সংস্কৃতির ওপর গবেষণা করে বাঙালি জাতিসত্তাকে বিশ্বে আরও উজ্জ্বল করতে পারে তা তো সবার জন্যই শুভ বার্তাবাহী।আমার একজন প্রাক্তন সহকর্মী জাপান সরকারের একটি বৃত্তি নিয়ে টোকিও যাচ্ছেন আসছে জুন মাসেই। তিনি বললেন, তার প্রতিষ্ঠানের পক্ষ থেকে তাকে জানিয়ে দেয়া হয়েছে, তিনি সেখানে গিয়ে যোগদানের আগে যদি জাপানি ভাষা কিছুটা রপ্ত করে যান তবে তাকে বিশেষ সুযোগ-সুবিধা প্রদান করা হবে। যুক্তরাষ্ট্রে তার থাকাকালীন সময়েই তাকে ভাষা শিক্ষা দেয়ার ব্যবস্খা করবে জাপানি ওই প্রতিষ্ঠান। বিশ্ব মানবের কাছে নিজেদের ভাষা ছড়িয়ে দেয়ার এই যে চেষ্টা এবং চেতনা তা অনুসরণযোগ্য। আর এর সঙ্গে অর্থ রোজগারের বিষয় তো রয়েছেই। আরেকটি সাম্প্রতিক উদাহরণ দিয়ে লেখাটি শেষ করব। একটি সংবাদ দেশে-বিদেশে ফলাও করে প্রচার করা হয়েছে। যুক্তরাষ্ট্র প্রবাসী, একজন অভিবাসী বাঙালি মহান একুশে, আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস উপলক্ষে যুক্তরাষ্ট্র ডাক বিভাগের (ইউএসপিএস) অধীনে একটি ডাকটিকেট প্রকাশের উদ্যোগ নিয়েছেন। এর প্রকৃত ঘটনাটি অন্যরকম। যুক্তরাষ্ট্রের কিছু লাইসেন্সধারী এজেন্ট রয়েছে যারা ডাকটিকিট প্রিন্ট করতে পারে। ডাক বিভাগের নিয়োগকৃত এসব এজেন্টের কাছে যে কেউ উপযুক্ত কারণ, শর্ত এবং আনুষঙ্গিক বিষয়াদি মেনে ডাকটিকিট প্রকাশের আবেদন করতে পারেন। তা তারা মেনে নিলে সাময়িকভাবে কম্পিউটার প্রিন্ট ডাকটিকিট প্রকাশের ব্যবস্খা করে। প্রধান শর্ত হচ্ছে লক্ষাধিক ডাকটিকিট এভাবে অনলাইনে বিক্রি করতে হবে। তা করতে পারলেই তারা ডাকঘরে ওই ডাকটিকিট বিক্রির উদ্যোগ নেবে। আসল কথা হচ্ছে অর্থ উপার্জন। অর্থ উপার্জনের উৎস করে দিতে পারলেই ভাষা সংস্কৃতি এখন আদৃত হচ্ছে বিশ্ববাজারে। তাই ভাষাকে টিকে থাকতে হচ্ছে এর সঙ্গে পাল্লা দিয়েই।
--------------দৈনিক সংবাদ। ঢাকা। ২১ ফেব্রুয়ারি ২০০৮ প্রকাশিত।

Tuesday, February 19, 2008

গুনিন


গুনিন

====

আমি না থাকলে এ স্থান দখল করে নেবে অন্য কেউ। অন্য কোনো

জমিনে দাঁড়িয়ে কৃষক ছড়িয়ে যাবে পুষ্ট আমন ধানএকদিন জাগবে চারা,

বইবে হাওয়া এই ক্ষেতসমগ্রে।আসবে ভাদ্র -অগ্রহায়ন, উঠবে ফসল কিষাণীর

ভাঙা গোলায়, স্বর্ণ হয়ে।আমি না এলে ও থেমে যাবে না ,এই পথমিছিল।

কাঁধে নায়েরভার টেনে এগিয়ে যাবে দাঁড়ের গুনিন। নদীর বাঁকে দাঁড়িয়ে

বিবাগী বাউল গেয়ে উঠবে আনমনে , আর তার বেহালা, বিরহে অনাগত

সুরসন্ধ্যায় থাকবে পথচয়ে এই ঘাটে আসিবে কালিয়া ।
আমি না গেলে ও ,জানি তুমি যাবে ছড়াতে জলচন্দন , আউলা বসন্তের

জারুল-শিমুলে। আরো কাম আর প্রেমের রেখারেণু দিয়েমিশানো মাটিতে

খুঁজবে একটি সমাধির অস্তিত্ব। এপিটাফ পড়বেকেউ,কেউ পড়বেনা

কিছুই।কারণ সবাই কবিতা পড়তে জানে না।

পাখিমেলা


পাখিমেলা

======

মনগুলো মিশে গেছে চর-শীতলক্ষ্যায়।

পায় যারা প্রাণপলির পূর্ণ সন্ধান

তারা অবশেষে মেতে উঠে হারানো

নক্ষত্র চারণে।মেনেসকল নেত্রনিয়ম,চোখ

দুটো স্থির রাখে বসন্তের বর্ণ-বিভায়।

চায়,অন্তিমে হলেও আবার দেখা হোক

তার সাথে। যেতে যেতে ভোর,নামুক দুপুর ,

ফালগুনের শিমুল সাম্রাজ্যে। মাঝে মাঝে বেজেউঠুক

বাঁশী, কৃষ্ণের হাত ধরে রাধা যেমন ভাসে কালের

খেয়ায়।পরিযায়ী প্রথমআকাশ পেরিয়ে

পাখিরা সাজায় মেলা,দোর রচনায়

Monday, February 18, 2008

ভাষার নিয়ন্ত্রণ, ভাষার পুরস্কার


ভাষার নিয়ন্ত্রণ, ভাষার পুরস্কার

ফকির ইলিয়াস

=====================

একটি ভাষার মাধ্যমে মানুষ তার জীবনকে প্রকাশ করে। ভাষাকে বদলেও দেয় মানুষ। নিজের মতো করে কাজে লাগায়। ভাষা নিজে প্রকাশিত হতে পারে না। যুগে যুগে প্রজন্মের বুননের মধ্য দিয়েই একটি ভাষা ক্রমশ তার পরিপূর্ণতা লাভ করে। ভাঙে আবার গড়ে।আমরা লক্ষ করলে দেখবো তিরিশের দশকে যে আঙ্গিকে, যে অবকাঠামোতে বাংলা সাহিত্য রচিত হয়েছে, এই শূন্য দশকে তেমনটি হচ্ছে না। তার কারণ, বদলে গেছে বিশ্বের চারপাশ। বেড়েছে নিসর্গের নানা নির্মিতি। যোগাত্মক এবং বিয়োগাত্মক দুটি দিকেই পরিবর্তন ঘটেছে। এ পরিবর্তন মেনে নিয়েই এগুচ্ছে জীবন-সমাজ-সংসার। এর সমন্বয় সাধন করেই যাচ্ছে মানুষ। নিজেকে তৈরি করছে নিজস্ব আঙ্গিকে। একটি ভাষাকে যারা নতুন নান্দনিকতায় রূপ দেন তারা হচ্ছেন সে ভাষার লেখক। লেখকরা প্রতিনিয়ত তাদের মননশীল চিন্তাটুকু ভাষার জন্য, ভাষার পাঠক-পাঠিকার জন্য রেখে যান। কিন্তু একটি ভাষার কাছে একজন লেখকের কি কিছুই চাওয়ার থাকে না? অবশ্যই থাকে।এ প্রসঙ্গে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের খ্যাতিমান কবি মি. জেমস টেটস-এর একটি উক্তি প্রণিধানযোগ্য। তিনি বলেছিলেন, সব সৃজনশীল লেখকই চান মহাকালের মানুষ তার লেখাগুলো গ্রহণ করুক। প্রকৃতপক্ষে যে ভাষার মানুষ, যে জাতি তার সৃজনশীল লেখকদেরকে বেশি মূল্যায়ন করে সে প্রজন্ম ততো বেশিই উপকৃত হয়। এবং এর ফল হয় সুদূরপ্রসারী।এসব কথা বাঙালি জাতিও জানে নানাভাবে। জানেন রাষ্ট্রকর্তারাও। তারপরও কোথায় যেন এক ধরনের অবহেলা। কোথায় যেন এক ধরনের হীনমন্যতা। চেয়ার দখলের প্রতিযোগিতা! কেন এমন করা হয়? এ সব প্রশ্নের কোনো জবাব নেই।ফেব্রুয়ারি মাস বাঙালির গৌরবের মাস। এ গৌরব রক্তের বিনিময়ে অর্জিত। মাসব্যাপী বইমেলার সংবাদটি এখন জানেন প্রায় গোটা বিশ্বের মানুষ। জানেন বিভিন্ন ভাষার লেখকরাও। তারপরও আমরা হতবাক হয়ে যাই, যখন দেখি বইমেলার মতো জ্ঞানার্জনের প্লাটফর্মটিও দখল করে রাখেন রাষ্ট্র শাসকরা। বইমেলার উদ্বোধন, সম্মানিত লেখকদের ওপর ছেড়ে দেওয়া যায় না? প্রকৃত লেখক কখনোই রাজনীতি দ্বারা প্ররোচিত হন না। হতে পারেন না। সত্যের সপক্ষে, মানুষের সপক্ষে, মানবতার সপক্ষে কর্মই তার বড়ো পরিচয়। আর কোনো পরিচয় তার থাকার কথা নয়। তারপরও লেখকদেরকে দলীয়করণের প্রতিযোগিতা আমরা লক্ষ করি।আমরা সংবাদ মাধ্যমে, বিভিন্ন গ্রন্থের প্রকাশনা অনুষ্ঠান দেখি। তাতে দেখা যায় অনুষ্ঠানের প্রধান অতিথি হয়েছেন কোনো মন্ত্রী, আমলা, শীর্ষ ব্যবসায়ী (নব্য মিডিয়া ব্যবসায়ীরাও যুক্ত হয়েছেন), কিংবা সমাজের অন্য কোনো ক্ষেত্রের ক্ষমতাবান। আমরা দেখি রাষ্ট্রের শীর্ষ কবি, লেখক, কথা সাহিত্যিকরা বসে আছেন দর্শক সারিতে। কেন এই জবরদখল?এই মানসিকতা থেকে লেখক-পাঠকসহ সর্ব শ্রেণীর সচেতন মানুষের বেরিয়ে আসা দরকার। মনে রাখতে হবে একটি প্রকাশনা উৎসব, কোনো জনসভা নয়। তাই তাতে কয়েক হাজার লোক সমাগমও আশা করা উচিত নয়। বিশ্বের শীর্ষ সেমিনার, সিম্পোজিয়াম, প্রকাশনা উৎসবগুলো, কয়েকশত মানুষের মাঝেই সীমাবদ্ধ থাকে। আর এই কয়েকশত মানুষই মূলত একটি সমাজের, একটি ভাষা বিনির্মাণের শীর্ষ নেতৃত্ব দিয়ে যান।
দুই.একটি ভাষাভাষি মানুষ যখন একজন লেখককে একগুচ্ছ ফুল দিয়ে পুরস্কৃত করে। তখন তাই হয়ে উঠে লেখকের জীবনের শ্রেষ্ঠ পাওয়া। বাংলা ভাষা এবং সাহিত্য আর তার নিয়ন্ত্রকরা এ বিষয়ে বড়ো কৃপণ বলেই আমার কাছে মনে হয়।বাংলাদেশে একটি মর্যাদাশীল পুরস্কার হচ্ছে ‘বাংলা একাডেমী পুরস্কার’। ১৯৬০ সাল থেকে এই পুরস্কার প্রবর্তন করা হয়। বাংলা একাডেমীর ওয়েব সাইটে দেওয়া তথ্যানুযায়ী জানা যায় এর মধ্যে ১৯৮৫, ১৯৯৭, ২০০০ বছরে কোনো পুরস্কার দেওয়া হয়নি। দেশে কোনো যোগ্য লেখক ছিলেন না এ সময়? নাকি রাজনৈতিক কারণে এই বছরগুলোতে একাডেমী পুরস্কার দেওয়া হয়নি? কেন দেওয়া হয়নি এর সুনির্দিষ্ট এবং ব্যাখ্যা সংবলিত কোনো কারণ একাডেমীর ওয়েব সাইটে নেই।লক্ষ করলে আরো দেখা যাবে যারা পুরস্কার পেয়েছেন, তাদের মাঝে বেশকিছু লেখক-লেখিকা ইতিমধ্যেই পাঠক বিস্মৃত প্রায়। এ প্রজন্মের অনেকেই এদের নামটি পর্যন্ত জানেন না। তাদের লেখালেখি পড়াতো দূরের কথা। মহাকাল এভাবেই একজন লেখকের ভাগ্য নির্ধারণ করে দেয়।কেউ হয়তো বলতে পারেন, বিশ্বখ্যাত নোবেল সাহিত্য পুরস্কার প্রবর্তিত হওয়ার পর পর্যন্ত, আজ অবধি যারা নোবেল পুরস্কার পেয়েছেন তাদের সবার নাম কি আমরা মনে রেখেছি? এর উত্তর ‘হ্যাঁ’ অথবা ‘না’ দুটোই হতে পারে। নোবেল যারা পেয়েছেন, তারা বিভিন্ন দেশের মানুষ। বিভিন্ন ভাষাভাষি লেখক-কবি। আমরা কবিগুর" রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরকে যেমন মনে রেখেছি, সে সব ভাষার কবি-লেখকরাও নিজ নিজ ভাষাভাষির কাছে সমানভাবে সমাদৃত। গোটা বিশ্বের সব ভাষাভাষি মানুষের সে খোঁজ নয়।বাংলা ভাষার লেখক কবি যারা মেধার মূল্যায়নে (অবশ্যই রাজনৈতিক কোটাভিত্তিক পুরস্কার বিবেচ্য নয়) একাডেমী পুরস্কার পেয়েছেন, তাদের লেখাগুলো, গ্রন্থগুলো, নিয়মিত পুনঃপ্রকাশ করেনি বাংলা একাডেমী। যার ফলে তারা কালের গহ্বরে হারিয়ে যেতে বসেছেন। এটা খুবই যৌক্তিক কথা, শুধু একজন লেখককে কিছু অর্থ সম্মানী আর ক্রেস্ট-সনদ দিয়ে দিলেই জাতীয় দায়িত্ব শেষ হয়ে যায় না। ঐ লেখকের লেখাগুলো সংরক্ষণ, পুনর্মুদ্রণ, রক্ষণাবেক্ষণ এবং পাঠকের কাছে পৌঁছে দেওয়ার দায়িত্বটুকুও পালন করতে পারে বাংলা একাডেমী, কৃতিত্বের সঙ্গে। এ ছাড়া বর্তমান তর"ণ লেখকদেরকেও বিভিন্নভাবে পৃষ্ঠপোষকতা দিতে পারে জাতীয় এই প্রতিষ্ঠান ‘বাংলা একাডেমী’।ভাবতে অবাক লাগে অনেক সাহিত্যিকও এখনো একাডেমী পুরস্কার পাননি। এমন কবি-লেখকদের তালিকা বেশ দীর্ঘই হবে যারা একাডেমী পুরস্কার পাওয়ার যোগ্যতা রাখেন কিš' এ যাবৎ পাননি। মেধাবৃত্তির বিবেচনায় একাডেমী পুরস্কার প্রদানে উদ্যোগী হবে বলেই জাতি আশা করে। মনে রাখতে হবে ভাষার প্রহরী লেখক-পাঠক-জনমানুষেরাই। রাষ্ট্র নায়করা এর প্রকৃত নিয়ন্ত্রক নন।
-----দৈনিক ভোরের কাগজ।ঢাকা। ১৯ফেব্রুয়ারি২০০৮ মংগলবার প্রকাশিত ।

নদীভৈরবী


নদীভৈরবী

---------

কামনার উপাত্তে ডুবি, নদীভোর পাশে রেখে

অন্য আঁধারে ঢাকা প্রতিবেশী যৌবন-অভিসারী

চোখ আর সঞ্চিত তাপগুলোর জমাট শরীর দেখে।
শোভাযাত্রা শেষ হলে সারিবদ্ধ মানুষ ও প্রস্তুত

হয় ঘরে যেতে। মেয়াদ উত্তীর্ণ আগুন এবং শুভাশুভ

বয়সের সীমারেখা তখন খোঁজে না সুপ্তির বিস্তার।
আবারো বিভক্ত হই। চাঁদের চতুর্থ নয়নে চিত্রিত

হয়ে নারীরা যেমন খোঁজে নদীর ভৈরবী বিলাস

আর নরের বাহু বেষ্টনী, স্রোত এবং শ্রুতির দ্যোতনা

হিমঘুম

হিমঘুম
=====
চোখে হিমঘুম। পতনের পদ্য শোনা যায়।মৃত্যু কি তবে পথের দুয়ারে !
কারে, বলে যাবো কি ! যখন শোনার কেউ থাকে মনের কোটরে
তখন ঘোর বনভূমিই হয়ে উঠে নিদান আশ্রয়
কেউ কেউ অবশ্য ভেঙে যেতে পারে ভুলের বলয়
তবে অনেকেরই হয় না বাঁচার ভাগ্য প্রত্নখনি
যদি হতো ,তবে প্রতিটি ঢেউ তুলে নিতো অগণিত পুরুষ-রমণী ।
বুকে ব্যথিত পাঁজর। হাড় ভাঙে শব্দ-কিনারায়। এইসব মাতাল পাথর
জানি কেউ সরিয়ে নেবে না , পৃথিবীর নগ্ন উষর
থেকে কোনোদিন। নাহলে ধরণীই হতো প্রিয় লীলাভূমি
ঝড়ের জ্যোতি নিয়ে আবারো, কাছে আসতে তুমি !

নরকনৃত্য

নরকনৃত্য
==========
নৃত্য শেষ হলে আবার মেতে উঠে ডার্করুম।
বিম্বিত নরকসুন্দরীর দীর্ঘ ছায়াএসে নাচায় পর্দার রঙ।
কেউ হাততালি দেয়।কেউ হাতের জলকলসি ভেঙেছুটে
নতুন গন্তব্যে। কিছুদূরে,আবারো ঝিমোয় আস্তাবলে লালঘোড়ার দল।
সাকীসম্বন্ধে এর আগেও বহুবার মেতেছে নরক।সুরার বিন্দু
বিন্দু মেঘ পড়েছড়িয়েছে সংবর্তের আলো। কাঁচের স্ফটিকে মিশে
থাকা চুম্বনের ঘ্রান নিয়েনতজানুকবি বসেছেন পূণ্যাশ্রমে।
পাশে ক'ফোঁটা জ্যাক ড্যানিয়েল,ক'টি ঘুঙুর।

সামাজিক উন্নয়নে পেশার সৃজনশীলতা

সামাজিক উন্নয়নে পেশার সৃজনশীলতা
ফকির ইলিয়াস
-----------------------------------------
আমাদের সমাজে আমরা দেখি কিছু কিছু পেশা এবং তা থেকে পেশাজীবীর পদবীটিও একটি বিশেষ ভাবমুর্তি নিয়ে প্রতিষ্ঠিত হয়ে যায়। তা শুধু একটি নির্দিষ্ট পেশা বা কাজ হিসেবে নয়, ঐ কাজের সঙ্গে কিছু বিশিষ্ট গুণাবলীর ধারক হিসেবেও। যেমন ‘শিক্ষক’ শব্দটির সঙ্গে সততা, সামাজিক নেতৃত্ব, একইভাবে ‘চিকিৎসক’ শব্দটির সঙ্গে সেবা, মহত্ব এসব গুণাবলী যুক্ত হয়েই ঐসব শব্দ ও পেশায় একএকটি বিশেষ ভাবমূর্তি তৈরি হয়েছিল। বাঙালির সমাজ ব্যবস্খায় এক সময় ‘শিক্ষক’ পেশাটি ছিল অত্যন্ত সম্মানীয়। ‘চিকিৎসক’ পেশাটির কথা উঠলেই একজন সেবকের মুখ আমাদের চোখের সামনে ভেসে উঠতো খুব শ্রদ্ধার সঙ্গে। বর্তমানে সেই ধ্যান ধারণার বিয়োগাত্মক পরিবর্তন হয়েছে।মানুষ এই চলমান সময়ে ‘শিক্ষক’ কিংবা ‘চিকিৎসক’ পেশাজীবিদেরকে আর আগের মতো শ্রদ্ধার চোখে দেখতে দ্বিধাবোধ করেন। এর কারণ কী? কারণ হচ্ছে, এই পেশা দুটিকে কিছু মানুষ খুবই ঘৃণ্য পর্যায়ে নামিয়ে এনেছেন। শিক্ষকের যে জ্ঞান-গরিমা থাকার কথা ছিল, তা ধারণ না করে এক-একজন শিক্ষক পরিচিত হচ্ছেন এক-একজন বিদ্যাবিক্রেতা হিসেবে।পত্রিকায় সংবাদ বেরিয়েছিল, বর্তমান বাংলাদেশ সরকার কোচিং সেন্টারগুলোর ব্যাপারে কঠোর ব্যবস্খা নিতে যাচ্ছে। যে সব কোচিং সেন্টার প্রতারণা করে ছাত্রছাত্রী, অভিবাবকদেরকে ঠকিয়েছে কিংবা এখনো ঠকাচ্ছে তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্খা নেবে সরকার। প্রাইভেট চিকিৎসা ক্লিনিকগুলোর ব্যাপারেও বিভিন্ন ইতিবাচক সিদ্ধাত্ম নেওয়া হবে বলে জানা গিয়েছিল।এপর্যন্ত তেমন কোনো ব্যবস্থানেয়নি বর্তমান সরকার।ইউরোপ-আমেরিকাসহ সভ্য গণতান্ত্রিক দেশে এই রেওয়াজ চালু আছে, রোগী যেই হোক তাকে জরুরি প্রয়োজনীয় চিকিৎসা হাসপাতাল কর্তৃপক্ষকে দিতেই হবে। চিকিৎসার বিল কে দেবে তা প্রাথমিকভাবে বিবেচ্য বিষয় কখনোই হয়নি। অথচ বাংলাদেশে আমরা দেখি মুমূর্ষু রোগী সামনে রেখে দরদাম হাঁকছেন চিকিৎসক।মানুষ স্বপ্ন পূরণের সিঁড়ি হিসেবে বিভিন্ন সৃজনশীল পেশাকে বেছে নেয়। সমাজ লজ্জা পায়, যখন দেখা যায় তেমনি সৃজনশীল কোনো পেশাকে ব্যক্তিগত হীনস্বার্থ হাসিলে কেউ ব্যবহার করছেন। মহান মুক্তিযুদ্ধ পরবর্তী বাংলাদেশে ‘সাংবাদিকতা’ পেশাটিকে একটি মননশীল ধারায় রূপ দিতে অনেকেই এগিয়ে এসেছেন। কিন্তু অন্যদিকে এই পেশাকে হীন স্বার্থ চরিতার্থ করার কাজেও ব্যবহার করেছেন কেউ কেউ। সামরিক জান্তাদের সঙ্গে হাত মিলিয়ে বাড়ি-গাড়িসহ নানা সুবিধা নেওয়ার পাশাপাশি রাজনীতিকদের খাস আনুকূল্যও নিয়েছেন কেউ কেউ।ভাবতে অবাক লাগে বর্তমানে ধ্বস নামা রাজনীতিকদের ঘনিষ্ঠজন বলে পরিচিত সাংবাদিক, সম্পাদকরা এখন দুর্নীতিবিরোধী সেজে নানা নসিহত শুনাচ্ছেন বাংলা দেশের মানুষকে। এখন তাদের লেখালেখি, রিপোর্ট দেখলে বুঝার কোনো উপায় নেই এক সময় তারা রাজ সম্পাদক (রাজ্যের পোষ্য সম্পাদক) ছিলেন। এরা আওয়ামী লীগের শাসনামলে যে তরিকা, বিএনপির আমলে জাতীয়তাবাদী তরিকা গ্রহণ করে ‘রাষ্ট্রের কল্যাণে’ নিজেদেরকে ব্রত রেখেছেন। এখন তারা বর্তমান তদারকি সরকারের মুখপাত্র সাজতেও ব্যস্ত।মহামহিম এডওয়ার্ড সাঈদ তার এক বক্তৃতায় বলেছিলেন,'' পেশাজীবীদের সৃজনশীল এবং সৎ ধ্যান-ধারণাই পারে সমাজের প্রকৃত উন্নয়ন ঘটাতে। সত্যনিষ্ঠ ব্যক্তিত্ববান মানুষ হচ্ছেন সমাজের আইকন। এদেরকে সমাজের ভিতও বলা হয়। যে সমাজে এই ভিত যতো বেশি গভীরে, সে সমাজই ততো শক্তিশালী।'' বাংলাদেশে গণতন্ত্র চর্চা এবং জনগণের আশা-আকান্ঙখা বাস্তবায়নে তৃণমূল পর্যায়ে সৎ মানুষের বেষ্টনী নির্মাণ সে জন্য খুবই প্রয়োজনীয়। মনে রাখতে হবে, যে ছাত্র বিদ্যা বিক্রেতা শিক্ষকের সাহচর্য পায়, সে কখনোই নিজেকে মহানুভবতার আলোয় আলোকিত করতে পারে না। কারণ তার জ্ঞানসীমা হয়ে পড়ে খুবই সীমিত।এখানে ভারতের একটি উদাহরণ টানা যায়। যুক্তরাষ্ট্রের আইটি, প্রযুক্তি, কারিগরি ফিল্ডে ভারতীয় তরুণদের পদচারণা দিনে দিনে বেড়েই চলেছে। যুক্তরাষ্ট্রের আর্থলিংক, ডেল কম্পিউটার, এটি এন্ড টি, ক্যাপিটাল ওয়ানসহ অনেক বহুজাতিক কোম্পানি শোরুম, অফিস খুলেছে ভারতের বিভিন্ন অঙ্গ রাজ্যে। টল ফ্রি নম্বরে নিউইয়র্কে বসে ফোন করলে, অপারেটর জবাব দিচ্ছে ভারত, ফিলিপিন কিংবা থাইল্যান্ড থেকে। এই যে ব্যবসায়িক মননের বিবর্তন তা সম্ভব হয়েছে রাষ্ট্রীয় সদিচ্ছার কারণে। গড়ে উঠেছে সৎ পেশাজীবী কর্মশক্তি। একটি প্রজন্মকে এগিয়ে নিয়ে যেতে সততার কোনো বিকল্প নেই। বাংলাদেশের অতি নিকট-প্রতিবেশী ভারত যা পারছে, বাংলাদেশ তা পারবে না কেন? তবে প্রথম কাজটি হচ্ছে সুবিধাবাদী পেশাদারদেরকে দমন করা।-##

কবিতার চিত্রকল্প, কালিক চেতনার ধারা

কবিতার চিত্রকল্প, কালিক চেতনার ধারা
ফকির ইলিয়াস
----------------------------------------------
বর্তমান কবিতাগুলো কি আসলেই খুব কঠিন হয়ে যাচ্ছে? নাকি ঝাপসা চিত্রকল্প এবং উপমার সমুদ্রে খেই হারিয়ে ফেলছেন পাঠক? ঝাপসা কিংবা কুয়াশাচ্ছন্ন ভোরের সুর্যোদয় যারা অবলোকন করেন তারা কি শুধুই স্বপ্নবিলাসী? এমন অনেকগুলো প্রশ্ন আজকাল প্রায়ই শোনা যায় আবার কেউ কেউ আধুনিক অনেক গদ্য কবিতায় তাদের ছন্দের ব্যারোমিটার বসিয়ে দুরবীন দিয়ে দেখার চেষ্টাও করেন কখনো তারা সফল হন কখনো তাদের প্রচেষ্টা ব্যর্থতায় পর্যবসিত হয় আবার কেউ কেউ নিজেকে ছান্দসিক কবি ভেবে আত্মতৃপ্তি লাভে আটখানা হন স্বপ্নবিলাস— তা যাই হোক না কেন, কবিতা যে এগিয়ে যাচ্ছে তাই হচ্ছে বর্তমানের প্রকৃত বাস্তবতা কোন্ কবিতা কালোর প্রতীক হয়ে দাঁড়াবে তা অতীতে যেমন বলা যায়নি, বর্তমানেও বলা যাবে না উদাহারণ স্বরূপ জীবনানন্দকে আবারো প্রণাম করি শতাব্দীর একপ্রান্ত থেকে অন্যপ্রান্ত পর্যন্ত তার বিচরণ আমাদেরকে আশান্বিত করেছে বৈকি! তার আধুনিক চেতনা এবং নান্দনিক প্রত্যয় কালের বাহক হয়েই থেকে যাচ্ছে— যাবে বহুবিংশ শতাব্দী পর্যন্ত তা এ মুহুর্তে নিশ্চিত করে বলা যাচ্ছে কবিতা লেখাকে অনেক কবি মৌলতাত্বিক এবং সমসাময়িক আর্টিস্টিক বলে মনে করেন তাদের এমন ধারণার পেছনে যুক্তিও আছে প্রচুর কারণ অনুভবের অনুসৃতি এবং প্রার্থনার চেতনা তো হৃদয় থেকেই উৎসারিত হয় একজন মানুষ চোখ খোলা রেখে অনেক কিছু দেখতে পায় আবার চোখ বন্ধ করেও অনেক কিছু দেখতে পায় একথা আমরা সবাই জানি এবং বুঝি কিন্তু হৃদয়ের চোখের আয়নায় দাঁড়াতে পারি কজন? কবিতার কল্পচিত্র সব সময়ই বিশ্বজনীন এবং সার্বজনীন
এ প্রসঙ্গে আমি কয়েকজন মার্কিন কবির সমসাময়িক কবিতার বাংলা তর্জমার কিছু খন্ডচিত্র তুলে ধরতে চাই এরা যুক্তরাষ্ট্রের স্বীকৃত কবি যারা কবিতার ব্যঞ্জনা এবং ঘূর্ণায়নের মাধ্যমে শৈল্পিক আবহকে এগিয়ে নিয়ে যাচ্ছেন ‘সোনালি মানুষ’ কবিতায় কবি ডানা লোভন সোনালি মানুষটিকে এভাবেই নির্মাণ করেন— ‘এবং এসিড এসে ধৌত করে দেয় তাকে,/ হ্যাঁ, আমি ছোট্ট মানুষটিকে নির্মাণ করছিলাম’ একটি কবিতা তখনই প্রকৃত সার্থকতা পায়, যখন একটি একান্ত ব্যক্তিগত অনুভুতি সার্বজনীনতা লাভ করে একটি হৃদয়ের আকাঙ্খা হয়ে ওঠে বহূ হৃদয়ের প্রভাষণ কবি ক্যাথরিন লিডিরার তার ‘বেঁচে থাকার একটি নতুন পথ’ কবিতাটির মুখবন্ধ শুরু করেছেন এভাবে— ‘আমি ক্লান্ত এভাবে ক্ষমা করতে করতে/ একটি রাত, একটি গাম্ভীর্যপূর্ণ ফোরাম যেমন/ একটি মধ্যতর্জনী’। একটি কবিতায় বহুমাত্রিক অনুযোগ কিংবা অনুপ্রাস কবিতাটিকে সমৃদ্ধ করে নি:সন্দেহে যেকথা অনেকে বলতে কিংবা লিখতে পারেন না,- তা কবি পারেন সেক্ষেত্রে কবি তার উত্তর প্রজন্মের জন্য নির্মাণ করেন একটি বিশুদ্ধ নিবাস কবি জন ইয়াউ-এর তেমনি কিছু কথা আমাদের কানে বাজে, বুকে লাগে তার ‘রাশিয়ান চিঠি-৩’ কবিতার কয়েকটি পঙক্তি— ‘প্রিয় মেঘের চিত্রকর/ কি প্রমাণ থাকবে সেখানে/ যখন দোকানী/ আমাদের ধুলিচিহ্ন ঝেড়ে ফেলে দেবে ছোট্ট নালীতে’ একইভাবে কবি ডানা লোভন-এর আহ্বান জাগিয়ে তোলে তার সহযাত্রী অনুজদেরকে ‘কাজ’ কবিতায় তার বাণীগূলো এরকম— ‘এই সেই আমেরিকা—/ তুমি পাত্রের মধ্যে পানি রাখো এই সেই তোমার শতাব্দী—/ যে চুলোয় তুমি আগুন জ্বালো/ তুমি অনুভব করো, এই শহর, তোমার চারদিকের ধুসর, যেভাবে তুমি কালো চা রাখো কাপের মাঝে’ যুক্তরাষ্ট্রের সমসাময়িক অন্যতম প্রধান কবি মি. জিরাল্ড স্টার্ন-এর স্বগতোক্তি থেকে কালিক কবিতা নির্মাণে চিত্রকল্পের ব্যবহার সম্পর্কে একটি স্পষ্ট ধারণা পাওয়া যেতে পারে স্টার্ন বলেন, আমার কবিতায় আমি আমার সময়কেই ধরে রাখতে চেয়েছি বর্তমানই ছিল আমার কাছে মূল বিবেচ্য বিষয় জীবনের রঙ অনেকটাই তো ফ্যাকাশে মহাসাগর পাড়ি দিয়ে যে জন এগিয়ে আসতে পারে সেই হয় ভাগ্যবান জীবনের অধিকারী কবিতায় সমসাময়িক বিষয় এবং চেতনার ব্যাপৃতি— বর্ণনা থাকা স্বাভাবিক শত বছর আগেএকজন কবি কম্পিউটার, ই-মেইল, ইন্টারনেট সম্পর্কে অবহিত ছিলেন না বর্তমানের কবিরা এই গ্লো­বাল ভিলেজে বসবাস করে এসব বিষয়গুলোকে রপ্ত করছেন মনে প্রাণে তাদের চিন্তা চেতনায় এখন সিলিকন ভ্যালি আলোর ঝলক একবিংশ শতাব্দীর দোরগোড়ায় দাঁড়িয়ে তাই তো,মাইকেল ও’ নীল বলে যান— ‘আমি ক্রমশ: শব্দগূলোকে বন্দী করছি একটি দুর্দান্ত বাক্সের ভেতর/ ফুলগুলো যেন ফুটছে আমার হাত দিয়ে সবুজ গোপনগুলো স্থির হয়ে দাঁড়াচ্ছে একটি কালো জমিনের বিপরীতে/ এভাবেই মধ্যরাতের আন্ত:জালে (ইন্টারনেটে) আমি খেলছি তোমার সাথে’ আধুনিক চিত্রকল্পগুলো, আধুনিক মননের বুনন এ বুনন তখনই আরো সমৃদ্ধ হয় যখন একটি কবিতার শিল্পায়ন ঘটে আন্তর্জাতিকতার নিরিখে যারা পশ্চিমা সাহিত্যের বিবর্তনকে ধনবাদী আধুনিকায়ন বলে নাক সিটকান তাদের অবগতির জন্য বলতে হয়, যে প্রক্রিয়া পাশ্চাত্যে শুরু হয়েছে অর্ধশতাব্দী আগে, প্রাচ্যে এখন তার অনুকরণ চলছে অতএব যদি চলমান সময়কে কবিতায় ধারণ করা না যায়, তবে হয়তো দু’ যুগ পরে আজকের কবি এবং কবিতা স্বকীয়তা নিয়ে আলোচনায় আসতে পারবেন না বাংলা সাহিত্যের অনেক স্বনামধন্য কবি আছেন যারা বলেন, বর্তমানে কবিতার কিছুই হচ্ছে না প্রশ্ন করতে ইচ্ছে করে— তারা কেন কিছু করছেন না বা করার চেষ্টা করছেন না একবিংশ শতাব্দীর শূরুতে দাঁড়িয়ে ক্ষণিক পিছন ফিরে তাকালে বেশ কিছু উত্থান চোখে পড়বে বেশ কিছু আধুনিক কবি তাদের চিত্রকল্প নির্মাণের মাধ্যমে যে চিহ্নতত্ত্ব সংরক্ষণ করে যাচ্ছেন তা নিয়ে হয়তো বিশদভাবে আলোচনা হবে সময়ে— ভবিষ্যতে কবিতার চিত্রকল্প সব সময়ই গতিশীল আর কবিরা সেই গতির শক্তি নিয়েই কালের দিকে ধাবমান
দুই.মনে পড়ছে একদিন টিএসসি তে আড্ডা দিচ্ছিলাম আমি , কবি মোহনরায়হান ও রুদ্র মুহম্মদ শহীদুল্লাহ । এ সময় আমার আরেক বন্ধু এগিয়ে আসেন । রুদ্র হাত বাড়িয়ে দেন। বলেন , ''আই এ্যাম রুদ্র মুহম্মদশহীদুল্লাহ , দ্যা পোয়েট ।''' মোহন ভাই হেসে ফেলেন। রুদ্র তার হাসি মুখে বলেন, ইয়েস, আইএ্যাম দ্যা পোয়েট । তা বলবো না ?হাঁ, একজন প্রকৃত কবির আত্মপ্রত্যয় এভাবেই সুদৃঢ় । কারণ তিনি জানেন ,তিনি কি করছেন। এ প্রসংগে ময়মনসিংহের এক প্রখ্যাত বাউল মরমী কবি উকিল মুন্সীরকথা আমার সব সময় মনে পড়ে। তাঁর একটা নন্দিত গান আছে, '' আমি আগে না জানিয়া সখীরে কইরে পিরীতি / আমার দু:খে দু:খে জনম গেলো , সুখ হইলো না এক রতি।''এই গানটি এখনো মুখে মুখে ফিরে । কেন ফিরে? কারন মানুষ এখনোবাউল উকিল মুন্সীর আত্মায়, প্রতিকৃতিতে নিজেকে খুঁজে পায়।একজন কবির সার্থকতা সেখানেই। কবিতার ভাষার প্রকাশভংগী বদলায় কালে কালে। বদলায় কবির বলারধরন। কিন্তু চন্দ্র , সূর্য, গ্রহ , নক্ষত্র , সমুদ্র , পর্বত সহ প্রকৃতির সিংহ ভাগ যেমন ছিল , তেমনি থেকে যায়। কবিতা বার বার আসে কালের আবর্তনে।কবির নতুন ধ্যানে .. চিত্রনে । =#####

প্রবাসে বাঙালির সংস্কৃতি চর্চা

প্রবাসে বাঙালির সংস্কৃতি চর্চা
ফকির ইলিয়াস
----------------------------------------------
নিউইয়র্কের এস্টোরিয়ায় ‘এথেন্স পার্ক’টি এক সময় ছিল গ্রিক-আমেরিকানদের সংস্কৃতি চর্চার কেন্দ্রবিন্দু। দু’দশক আগে কখনও ভাবাই যেত না, এই এথেন্স পার্ক একদিন বাঙালি অভিবাসীদের অনুষ্ঠানমালায় মুখরিত হয়ে উঠবে। অথচ আজ তাই হয়েছে। এই স্বপ্নকে বাস্তবে রূপ দিয়েছে প্রবাসের একটি অত্যন্ত সুপরিচিত সংগঠন ‘বাংলাদেশ ইন্সটিটিউট অব পারফর্মিং আর্টস’ (বিপা)। বিপা যুক্তরাষ্ট্রে বাংলা সংস্কৃতি চর্চায় একটি বিপ­ব ঘটিয়েছে তা বলা যায় আজ খুব দৃঢ়তার সঙ্গে। বিপা গেল ছ’বছর যাবৎ এথেন্স পার্কের মুক্তমঞ্চে আগস্ট মাসের প্রতি শুক্রবার বিকালে ৪ ঘন্টাব্যাপী অনুষ্ঠানমালা করছে অত্যন্ত কৃতিত্বের সঙ্গে। গান, নাচ, নাটক, মূকাভিনয়, কবিতা আবৃত্তি, পুঁথিপাঠসহ বিভিন্ন সূচি থাকছে এসব অনুষ্ঠানে।বিপা এ পর্যন্ত বেশ কিছু নবীন প্রজন্মেরর অভিবাসী বাঙালি শিল্পীও সৃজন করেছে। সেমন্তী ওয়াহেদ তাদেরই একজন। সেমন্তী গেল ক’মাস আগে ঢাকায় বিভিন্ন অনুষ্ঠান করে কৃতিত্ব কুড়িয়েছেন। তার পারফরম্যান্স প্রশংসিত হচ্ছে দেশে-বিদেশে। বিপা’র ছাত্রছাত্রীর সংখ্যা শতাধিক। প্রবাসে এভাবেই গড়ে উঠছে মিনি বাংলাদেশ। শক্ত হচ্ছে বাংলা ভাষা, বাঙালির সংস্কৃতির শিকড়।বিদেশে যে লাখ লাখ বাঙালি প্রজন্ম বেড়ে উঠছে, তাদের ‘সুন্দরতম ভূমি বাংলাদেশ’কে বিশদভাবে জানাতে এগিয়ে এসেছিলেন বাংলা সাহিত্যের এক কৃতী পুরুষ বিশিষ্ট সাহিত্যিক, প্রাবন্ধিক কবি ড. হুমায়ুন আজাদ। তিনি লিখেছিলেন একটি চমৎকার গ্রন্থ ‘মাই বিউটিফুল বাংলাদেশ’। শিশু কিশোর-কিশোরীদের পঠন উপযোগী এ গ্রন্থটি প্রকাশ করেছিল নিউইয়র্কভিত্তিক প্রকাশনা-বিপণন সংস্খা ‘মুক্তধারা’। গ্রন্থটি ইউরোপ এবং উত্তর আমেরিকার অনেক বাংলা স্কুলে পঠিত হচ্ছে। অনেক মাতা-পিতা তাদের সন্তানদের হাতে তুলে দিয়েছেন এই গ্রন্থটি।
বাংলা শিক্ষানবিসদের উপযোগী আরেকটি বাংলা বই খুব সহজ ভাষায় লিখেছেন নিউইয়র্ক প্রবাসী টিভি ব্যক্তিত্ব, প্রাবন্ধিক বেলাল বেগ। তার গ্রন্থটিও প্রশংসিত হয়েছে পাঠক মহলে। বিশেষ করে লন্ডন এবং নিউইয়র্ক নগরী এখন গড়ে উঠেছে বাঙালির শ্রেষ্ঠ অভিবাস ভূমি হিসেবে।লন্ডন প্রবাসী বাঙালিরা দাবি করছেন, ইংল্যান্ড এখন ‘তৃতীয় বাংলা’। একই দাবি নিউইয়র্কবাসীরও। চলছে পরিশুদ্ধ সংস্কৃতি চর্চার প্রতিযোগিতা। বাংলাদেশ এবং পশ্চিম বাংলার পর ‘তৃতীয় বাংলা' নামক চারণভূমিটি কোথায় তৈরি হবে তা স্পষ্ট করে বলার সময় হয়তো এখনও আসেনি। কিন্তু অভিবাসী বাঙালির সংখ্যা যেভাবে বাড়ছে, তার অব্যাহত ধারায় এক সময় ‘তৃতীয় বাংলা’ কিংবা ‘চতুর্থ বাংলা’র অস্তিত্ব যে বিকশিত হবেই তা এখন সময়ের ব্যাপার মাত্র।দুই. প্রবাসে বাংলা ভাষা, বাংলা সংস্কৃতি চর্চার পথিকৃত হিসেবে অনেকের ভূমিকা স্মরণযোগ্য। একজন অগ্রজের কথা না বললেই নয়। তিনি ইংল্যান্ড প্রবাসী প্রয়াত তাসাদ্দুক আহমদ। ষাটের দশকে ব্রিটেনে এসে বিলেতে বাংলা সংস্কৃতি চর্চার যে ঝাণ্ডা তিনি উড়িয়েছিলেন তা আজও উড়ছে ইংল্যান্ডের আকাশে গৌরবের সঙ্গে। তাসাদ্দুক আহমদ তার কর্মের জন্য ব্রিটেনের রানীর দেয়া ‘এমবিই’ খেতাব পেয়েছিলেন।
মনে পড়ছে, ১৯৯২ সালে ইংল্যান্ডে দেশ বিকাশ নামের একটি সাংস্কৃতিক সংগঠনের আয়োজনে বাংলাদেশ মেলায় অংশগ্রহণের সুযোগ আমার হয়েছিল। সে অনুষ্ঠানের প্রধান অতিথি তাসাদ্দুক আহমদ তার স্বপ্নের কথা আমাদের বলেছিলেন। তিনি বলেছিলেন, এই প্রবাসী প্রজন্মের সুযোগ্য সন্তানরাই একদিন তাদের শিকড় ভূমি বাংলাদেশের পাশে গিয়ে দাঁড়াবে। এরা জানবে তাদের মূল ধারার কথা। তাদের ইতিহাস, ঐতিহ্য, সভ্যতা, সংস্কৃতির কথা। তারা তা ধারণ করবে মনেপ্রাণে।
ব্রিটেনে এখন বেশক’টি প্রতিনিধিত্বশীল সাংস্কৃতিক সংগঠন কাজ করছে মাঠ পর্যায়ে। ‘বিশ্বসাহিত্য কেন্দ্র’ ইংল্যান্ড শাখা নিয়মিত কার্যক্রম চালু করেছে গেল পাঁচ বছর যাবৎ। ‘চারণ’ নামের একটি সাংস্কৃতিক চক্রও গড়ে তুলেছেন বেশ কিছু মননশীল তরুণ-তরুণী। লন্ডনের বাংলা টাউনে বাংলাদেশ মেলা, বৈশাখী মেলার আয়োজন হচ্ছে প্রতি বছর খুব জমকালো আঙ্গিকে। অংশ নিচ্ছেন দেশ ও প্রবাসের শিল্পীরা।
একইভাবে কানাডার টরন্টো, মন্ট্রিয়েলেও বেশ কিছু সাংস্কৃতিক সংগঠন প্রতিবছর নাচ, গান, সেমিনার, নতুন প্রজন্মের জন্য মুক্ত ফোরামসহ ব্যাপক আয়োজন করছে। ১৯৮৭ সালে ফেডারেশন অব বাংলাদেশী অর্গানাইজেশন অব নর্থ আমেরিকা (ফোবানা) নামে একটি ছাতা সংগঠন জন্ম নিয়েছিল উত্তর আমেরিকায়। কিন্তু দু:খের কথা নেতৃত্বের কোন্দলের শিকার হয়ে ফোবানা এখন বহুধাবিভক্ত হয়ে পড়েছে। যে লক্ষ্য নিয়ে ফোবানার জন্ম হয়েছিল, সে লক্ষ্য থেকে সম্পূর্ণই সরে এসেছে উদ্যোগটি। পরিকল্পনা চলছে সেপ্টেম্বর মাসের প্রথম সপ্তাহে গোটা উত্তর আমেরিকার বিভিন্ন অঙ্গরাজ্য এবং কানাডা জুড়ে প্রতিটি অঙ্গরাজ্যে ‘বাংলাদেশ সম্মেলন’ আয়োজন করার। বিভিন্ন অঙ্গরাজ্যের সংগঠনগুলো এ বিষয়ে উদ্যোগ নিচ্ছে ইতিমধ্যে।তিন. যুক্তরাষ্ট্রে বাংলাদেশ, বাংলা সংস্কৃতিকে তুলে ধরতে আঞ্চলিক সংগঠনগুলো ব্যাপক ভূমিকা রাখছে। সিলেট সদর থানা এসোসিয়েশন গেল পাঁচ বছর যাবৎ সুবিশাল পরিসরে বাংলাদেশ মেলার আয়োজন করছে নিউইয়র্কে। একই ধারায় এগিয়ে এসেছে চট্টগ্রাম সমিতি, বিয়ানীবাজার সামাজিক-সাংস্কৃতিক সমিতি, জ্যামাইকা ফেন্সন্ডস সোসাইটি, ব্রঙ্কস্ বাংলাদেশ সোসাইটিসহ বেশ কিছু সংগঠন।বোস্টনে কিশলয় বাংলা স্কুল, ওয়াশিংটন বাংলা স্কুল, কিংবা নিউইয়র্কে উদীচী শিল্পীগোষ্ঠী, তরঙ্গ শিল্পীগোষ্ঠী, বাংলাদেশ কালচারাল সেন্টার, বিশ্বসাহিত্য কেন্দ্র যেসব প্রোগ্রাম করছে তা প্রবাসে সংস্কৃতি চর্চার পরিপূরক সর্বাংশে। তাছাড়া প্যারিসে পার্থ প্রতিম মজুমদার কিংবা ক্যালিফোর্নিয়ায় কাজী মশহুরুল হুদার মতো কৃতী মূকাভিনেতা অথবা শিল্পী কাদেরী কিবরিয়া, পণ্ডিত রামকানাই দাশ, শিল্পী কাবেরী দাশ, শিল্পী দুলাল ভৌমিক প্রমুখের উজ্জ্বল ভূমিকা কি অস্বীকার করা যাবে? কিংবা প্রামাণ্যচিত্র নির্মাতা বিশিষ্ট চিকিৎসক ডা. জিয়াউদ্দিন আহমেদের কথা?
অতিসম্প্রতি নিউইয়র্কে সিলেট সদর হাউসে আয়োজন হল প্রবাসী শিল্পী তাজুল ইমামের একক চিত্র প্রদর্শনী ‘স্মৃতি-সত্তা-বোধ’। তার কর্মে প্রবাসের জীবনঘনিষ্ঠ চিত্রই ফুটে উঠেছে প্রাঞ্জলভাবে। তাজুল ইমাম একের ভেতরে অনেক। শিল্পী, সুরকার, চিত্রকর, গল্পকার, গীতিকার, গ্রাফিকস ডিজাইনার। প্রবাসে শিল্পী সত্তার ‘আইকন’ তৈরি হয়ে গোটা বিশ্বে বাংলা সংস্কৃতির দ্যুতি ছড়িয়ে দেবে এ প্রত্যাশা প্রবাসী সমাজের। পশ্চিম বাংলার বাঙালিদের আয়োজন বঙ্গ সংস্কৃতি সম্মেলন উত্তর আমেরিকায় আয়োজিত হচ্ছে পঁচিশ বছরেরও বেশি সময় ধরে। এ সম্মেলনে বাংলাদেশের বাঙালিদের অংশগ্রহণও বাড়ছে। বেশ ক’টি নাট্য সংগঠন নিউইয়র্কের ব্রডওয়ে শো’তে অভিনয় করার সুযোগ পেয়েছে। নিউইয়র্ক পাবলিক লাইব্রেরি বেশ ক’জন বাঙালি লেখক-পাঠককে তাদের সেশনে পাঠ করার সুযোগ দিয়েছে গেল পাঁচ বছরে। এর পরিসর ক্রমশ বাড়ছে। অভিবাসন একটি চলমান প্রক্রিয়া। এই প্রক্রিয়ায় বাঙালিরা ছড়িয়ে পড়বেই বিশ্বের দেশ-দেশান্তরে। বিশ্বায়ন তাদের ডেকে নেবে আরও কাছাকাছি। তারা বিদেশে যাওয়ার সময় নিজ সংস্কৃতি বহন করে নিয়ে যাবেন এবং তা তুলে ধরবেন যুগে যুগে কালে কালে।চার.বাংলা সাহিত্য সংস্কৃতির চর্চা চলছে অষ্ট্রেলিয়া, জাপান, সুইডেন ,জার্মানীসহ সৌদীআরব, কু্য়েত, কাতার, বাহরাইন, ওমান, আরব আমীরাত - মধ্যপ্রাচ্যের অনেক দেশে। প্রবাসী-অভিবাসী বাঙালীরা জাগিয়ে রাখছেননিজ সভ্যতা। অনেক প্রবাসী কবি লেখকের বই বের হয় বইমেলায়।অনলাইন ম্যাগাজিন , ব্লগে লেখালেখি সহ প্রতিদিনের কর্মকান্ড নজর কাড়ার মতো। এর ব্যাপৃতি যতো এগিয়ে যাবে ততোই লাভবান হবেপ্রবাসী প্রজন্ম।-#####

কাব্যসংসারে কবির দায়, পাঠকের দায়িত্ব

কাব্যসংসারে কবির দায়, পাঠকের দায়িত্ব
ফকির ইলিয়াস
--------------------------------------------
একটি কাব্যসংসারের অংশীদার দু'জন। কবি ও পাঠক কিংবা পাঠিকা। কবি বাগান সাজান । পাঠক তা ভোগ করেন। এই যে দান এবং গ্রহণের আনন্দ , তা -ই একটি কবিতাকে মহিমান্বিত করে তোলে বার বার। কালের পর কাল । প্রজন্মের পর প্রজন্ম।ধরা যাক কবি জীবনানন্দ দাশের কথা।জীবনানন্দ দাশ তাঁর জীবদ্দশায় ততোটা আলোচিতহতে পারেন নি , যা পরে হয়েছেন।তাঁর ''কবিতার কথা'' আমি যে কোনো নবিশ কবিতানুরাগীকে পড়তে বিনীত অনুরোধ করি।আধুনিক কবিতা সমকালীনতার প্রান্জল বুনন। প্রকৃতি যেমন ছিল তেমনি আছে। একজন নতুন কবিকে নিজের চিত্রকল্প এঁকে যেতেই হয়।দায় কিন্তু পাঠকেরও আছে । ছন্দ সমিল কবিতা খুঁজে অতীতে ফেরার চেষ্টা না করে পাঠককে ভাবতে হবে , একবিংশ শতাব্দীতে লেখা হচ্ছে '' দৃশ্য কবিতা''।সিলিকন ভ্যালীর আলোয় বসে যে কবি, নির্মাণের নৃতত্ত্ব আঁকছেন , তার পংক্তিমালায় তিরিশের চিত্রকল্প , উপমা , অনুপ্রাস খুঁজে পাওয়া না ও যেতে পারে।এ কথা খুবই সত্য, যদি সবাই কবি হতে পারতেন , তবে সব ভাষাসাহিত্যের সকল অধ্যাপকরাই হতেন বড় বড় কবি। তারা ই হতেন সব কবিতার নিয়ন্ত্রক। কিন্তু তা কোনো কালেই হয়নি।আমার দেখে হাসি পায়, যারা শুদ্ধ করে বাংলা লিখতে পারেন না তারা ও কবিতা লিখেন । কাগজে পাঠান ।খাতির থাকলে ছাপাও হয়।আমার কথা হচ্ছে যারা এই শুন্যদশকে ও প্রকৃত কবিতাগুলো লিখছেন, তারা তো বাংলা শব্দ ই ব্যবহার করছেন। তা হলে পাঠক-পাঠিকারা না বুঝার কৈফিয়ত তুলবেন কেন ? ব্যর্থতা টা কার ?দুর্বোধ্য বলে কবিতায় কিছু আছে বলে আমি মনে করিনা।যিনি পড়ছেন , তার পঠন-পাঠনের গভীরতা কতটুকু আছে ,তা ও বিবেচনায় রাখা জরুরী।এক সময় জীবনানন্দ দুর্বোধ্য ছিলেন ! এখন বহুল নন্দিত ।হয়তো অবহেলা ছিল ,তাঁর প্রতি । সমকালীন পাঠক তা খন্ডন করে এগিয়ে গেছেন আরেকধাপ। দুই।===একটি কবিতাকে কে কিভাবে বিশ্লেষণ করেন , তা ও বিবেচ্যবিষয়। কবি যে মনন নিয়ে লিখেছেন , পাঠক সে চোখ দিয়েনা ও দেখতে পারেন। এই কবিতাটি পড়া যাক-----
'' নারীর ভিতরে ডুবে পুরুষটির মৃত্যু হয়েছিল।বালির উপর ছড়িয়ে আছে/ তার চশমা, বই ও ব্রিফকেস। সে নেই কিন্তু একটা পড়ে-থাকা শুন্য কাঁচের/ বোতলে তার আবছা প্রতিবিম্বআটকে আছে। সেই প্রতিবিম্ব এখনো হাসছে,/ হাত নাড়ছে,কথা বলছে, মাঝে-মধ্যে রুমালে মুছে নিচ্ছে চুম্বনসিক্ত ঠোঁট।/
আর, অসংখ্য ডুবুরি সেই বোতলের ভিতরে ঢুকে খুঁজে চলেছেতাঁর মৃতদেহ ''( মদ/ রণজিৎ দাশ / শ্রেষ্ট কবিতা )
কবিতাটির চিত্রকল্প কি খুব কঠিন ? কারো কাছে তা লাগতেই পারে। তারপরও এটি একটি সার্থক কবিতা।আসুন , আরেকটি কবিতা পড়ি -----
'' তোমরা চলে যাচ্ছ, ট্রাকে মালামাল উঠে গেছে সব, এক জীবনে মানুষের কতবার যে বাড়িবদল জরুরি হতে পারে মানুষও বুঝি তা জানে না
একদিন এভাবেই ট্রাকে মাল বোঝাই করে রেলিঙ ঘেরা এই বাড়ির একতলায় তোমরা নোঙর ফেলেছিলে-- অতিথি পাখি ও গৃহস্থ বিড়াল একদিন ভোরবেলা চার সদস্যের একটি নির্ঝঞ্ঝাট পরিবার দেখে আহ্লাদে উল্লাস করেছিল
তোমরা ত্যাগ করে যাচ্ছ একটি অভ্যস্ত পরিমণ্ডল, তার বিয়োগ ব্যথায় তুমি কাঁদলে তোমার মা কাঁদল, ট্রাকের সিটে গিয়ে বসলে সবাই, তুমি, তোমার মা, ছোট ভাই, কুমারী আত্মীয়া-- বাবাকে তো আগেই রেখে এসেছ অনিবার্য মাটির বিছানে
গাড়ি স্টার্ট নিতেই তাড়াতাড়ি হাত নাড়লে তোমরা সবাই, শেষবার তাকালে, বাড়িওয়ালা অনুভূতিহীন, তখনই টাঙিয়ে দিচ্ছেন ভাড়াটে ধরার 'টু লেট' বাহানা, ঘরে জল ঢেলে ধুয়েমুছে দেয়া হচ্ছে তোমাদের সুদীর্ঘ ছোঁয়া
সব মায়া কাটিয়ে বাধ্য হয়ে তোমরা শহরান্তরে যাচ্ছ, পেছনে কাজলা বিড়ালটি দৌড়াচ্ছে... দৌড়াচ্ছে... দৌ...ড়া...চ্ছে''(বিড়ালটি/ মুজিব মেহদী)
কতো মর্মস্পর্শী এই কবিতাটির বুনন।
তিন।====বাংলা দেশে / কলকাতায় একটা কবিতার বই ছাপা হয় (সবার নয় অবশ্য) ৫০০/ ১০০০।এমন কি পাশ্চাত্যে ও কাব্যগ্রন্থের কাটতি কম ।কেন ?এ সময়ের আলোচিত মার্কিনী কবি ইউসেফ কমুনিয়াকা' র ''টকিং ডার্টি টু দ্যা গডস''পড়ুন। দেখবেন কবিতার বিবর্তন কিভাবে ঘটিয়েছেন তিনি।সময় কে ধারণ করতেই হবে।আমি নিশ্চিত , ১০০ বছর পর আরো বদলাবে কবিতার বুনন।তা কেউ আটকাতে পারবে না। পারা সম্ভব ও নয়।না , কবিতা ব্রক্ষ্মবাদ নয়। সবাই স্পর্শ করুক , তা সব কবিই চান। কিন্তু স্পর্শ করার মনন ও তো থাকতে হবে।কবি তো শিক্ষক নন , যে ক্লাশ করাবেন। তিনি লিখবেন তার ভাষায়। ভাষা শেখানোর দায়িত্ব তো কবি নিতে পারেন না।অনেক ভালো , মেধাবী , সৃজনশীল কবি আছেন। এরা নতুন।যারা খুবই ভালো লিখেন। কিন্তু সেগুলো ক'জন পড়েন ?শুধু একটু বাহবা ই দায়িত্ব শেষ ? না , তা বোধ হয় নয় ।শামসুর রাহমানের 'স্বাধীনতা তুমি' , ''তোমাকে পাওয়ার জন্য হে স্বাধীনতা'' - এগুলো কেও প্রথম প্রথম অনেকে কবিতা বলে নি। বলেছে এগুলোতো গদ্য । এখন সে মানসিকতা অনেকের বদলেছে। আরো বদলাবে , সন্দেহ নেই।পথে হাঁটতে হলে পথ চিনতে হবে। কবিতার আলোই টেনে নিয়ে যাবে পথচারীকে।
পাঠকের অবশ্যই অধিকার আছে ,তিনি কি পড়বেন - কি পড়বেন না।মানুষের জীবন খুব ছোট। তাই পছন্দ করে পড়া অবশ্যই জরুরী।যারা অবিন্যস্ত লেখেন , এরা অটোম্যটিকেলি বাদ পড়ে যাবেন, এতে কোনো সন্দেহ নেই। তা নিয়ে ভাবার ও কোনো দরকার আছে বলে আমি মনে করি না।কবিতা মানেই কয়েকটা শব্দের সংযুক্তিই নয়।কবিতা চিত্রকল্প , উপমা,উৎপ্রক্ষা , অনুপ্রাস সহ বিনির্মাণের সমন্বয়।না, কবি নিজে পড়ার জন্য লিখেন না। লিখেন সবার জন্য।তবে বুঝিয়ে দেবার দায়িত্ব তিনি নিতে পারেন না।বেছে বেছে পড়লে পাঠকের মনন সময়ই সমৃদ্ধ করে।
আবারো বলি ,- যারা আধুনিক , উত্তরাধুনিক , মৌলাধুনিক কবিতার রসাস্বাদন করতে চান তারা কলকাতার শক্তি ,সুনীল, জয় থেকে আজকের বিকাশ সরকার , বিনায়ক বন্দোপাধ্যায় এবং বাংলাদেশের আবু জাফর ওবায়দুল্লাহনির্মলেন্দু গুণ , হেলাল হাফিজ, মোহাম্মদ রফিক থেকে আজকের আবু হাসান শাহরিয়ার পর্যন্ত পড়ে দেখতে পারেন।চলমান বাংলা সাহিত্যে অনেক ভালো কাজ হচ্ছে কবিতায়।পড়তে হবে.. পড়তে হবে ...এবং পড়তে হবে।পড়ার কোনো বিকল্প নাই । পঠন -পাঠনই বাড়িয়ে দিতেপারে কাব্যসংসারের প্রঘাঢ় প্রেম ।================নিউইয়র্ক , ০১ জানুয়ারী ২০০৮

ভাষার অর্জন, প্রজন্মের ভাষাপ্রেম

ভাষার অর্জন, প্রজন্মের ভাষাপ্রেম
ফকির ইলিয়াস
------------------------------
শুধু ভাষার সৌন্দর্যই নয়, রাষ্ট্রের অবকাঠামোর সৌন্দর্য, স্খিতিশীলতা এবং শান্তির অব্যাহত ধারা বহাল থাকলে বাংলাদেশও হতে পারে বিশ্বের অন্যতম বিনিয়োগ, পর্যটন এবং বাণিজ্য নগরী। আর সেজন্য রাষ্ট্রীয়, রাজনৈতিক সদিচ্ছার প্রয়োজনীয়তা থেকেই যাচ্ছে। আমি মনে করি, প্রজন্মকে ভাষাপ্রেমে উদ্বুদ্ধ করতে হলে আগে সামাজিক নিরাপত্তা, শিক্ষার উজ্জ্বলতা দিতে হবে। সকল বাধা সরিয়ে নিতে হবে। শুধু অর্জন নিয়ে বসে থাকলেই চলবে না, অর্থনৈতিক, সামাজিক মুক্তিই দিতে পারে ভবিষ্যৎ প্রজন্মের শান্তির নিবাস।
যুক্তরাষ্ট্রের ওয়ার্ল্ড হেরিটেজ সিরিজ আয়োজিত একটি সেমিনারের প্রধান আলোচ্য বিষয় ছিল ভাষার অর্জন। একটি ভাষা কী ফসল ফলাতে পারে সে বিষয়ে ভাষা বিশেষজ্ঞরা বক্তব্য রাখছিলেন। একজন স্প্যানিশ ভাষা বিশেষজ্ঞ জিসান রডরিগাস তার বক্তব্যে তুলে ধরেছিলেন, সাহিত্য-সংস্কৃতিতে স্প্যানিশ ভাষার অগ্রগতি এবং আধিপত্যের কথা। তিনি স্প্যানিশ ভাষাভাষী কজন নোবেল বিজয়ী সাহিত্যিকের নাম উলে­খ করে বলেছিলেন, এরা স্প্যানিশ ভাষায়ই তাদের লেখাগুলো লিখেছিলেন। তাদের লেখার দক্ষতা, মুন্সিয়ানা, ভাবপ্রকাশ এবং বিষয় নির্বাচন বিশ্বের বোদ্ধা পাঠককে সাড়া দিতে সক্ষম হয়। তারপর স্খান করে নেয় বিশ্ব সাহিত্যে। একটি লেখা যখন নিজ ভাষায় বিশ্ব মানবের পক্ষে, বিশ্বভাষা হয়েই মাথা উঁচু করে তখনো গোটা মানবসমাজ তা গ্রহণে আগ্রহী হয়ে পড়ে। একুশে ফেব্রচ্ছারি এলে বাঙালিরা বাংলাভাষার অর্জন, দেনাপাওনার হিসাবও মেলানোর চেষ্টা করেন। সন্দেহ নেই ১৯৫২ সালে বাংলা ভাষার জন্য রক্ত দিয়ে যে স্বাধিকার প্রতিষ্ঠার বীজ বপন করা হয়েছিল, তা আজ সুপ্রতিষ্ঠিত হয়েছে। একটি রাষ্ট্র, একটি বৃহৎ জাতি­ বাংলাদেশ এবং বাঙালি।
একটি রাষ্ট্রে একটি ভাষাই যে সবার মাতৃভাষা হবে, তারও কোনো সম্ভাবনা শতভাগ নিশ্চিত নয়। বাংলাদেশে উপজাতি মানুষের ভাষার দিকে নজর দিলে আমরা সে দৃষ্টাìত্ম পাবো। আর বহুজাতিক-বহুভাষিক ‘মাল্টিকাচারাল কান্ট্রি’ বলে সুপরিচিত যুক্তরাষ্ট্র তো তার বড়ো উদাহরণ। ভাষার স্বীকৃতি দিতে গিয়ে নিউইয়র্কের বোর্ড অফ এডুকেশন বাংলা ভাষাভাষী দোভাষীর ব্যবস্খা করেছে। বিভিন্ন হেলথ ইনস্যুরেন্স, হাসপাতালগুলো গর্বের সঙ্গে সাইনবোর্ড ঝুলিয়ে রেখেছে-‘আমরা বাংলায় কথা বলি’। বাংলা ভাষার এই অর্জন প্রজন্মের জন্য দ্বার উন্মুক্ত করছে এই বিদেশেও।
আরেকটি গুর“ত্বপূর্ণ বিষয় হচ্ছে ভাষার সঙ্গে অর্থনীতির ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক। চীন এ সময়ে প্রোডাকশনের ক্ষেত্রে বিশ্বের চারণ ভূমি। তাই বহুজাতিক কোম্পানিগুলো তাদের নিজস্ব শোরুম, নির্মাণ কারখানা তৈরি করছে চীনে। এজন্য এখন যারা যুক্তরাষ্ট্রের বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বিজনেস ম্যানেজমেন্টে উচ্চশিক্ষা নিচ্ছে, কিংবা নিতে চাইছে তাদের জন্য চীনা ভাষা অপশনাল করা হয়েছে। এবং অনেক নবিস ব্যবসায়ী নিজ ব্যবসা প্রসারের প্রয়োজনে জাপানি, কিংবা চীনা ভাষা রপ্ত করে নিচ্ছেনও। লক্ষ্য একটিই, বিশ্বে ব্যবসার প্রসারকে হাতের মুঠোয় নিয়ে আসা। চীন, জাপান, হংকং, কোরিয়া প্রভৃতি দেশের বাণিজ্যিক ভবিষ্যৎই তাদের ভাষা প্রসারে বিশ্বব্যাপী ভূমিকা রাখছে। দৃষ্টি কাড়ছে বিলিয়নিয়ার ব্যবসায়ীদের।ভাষা একটি রাষ্ট্রের সংস্কৃতিকে প্রভাবিত করে গভীরভাবে। যে শিশু ঐ রাষ্ট্রের ভাষার মর্ম মূলে পৌঁছতে পারে, তার লক্ষ্যের পরবর্তী ধাপটি হয় সে ভাষার সংস্কৃতি-ঐতিহ্য সম্পর্কে জানা। যুক্তরাষ্ট্রের স্কুলগুলোতে প্রথম থেকে পঞ্চম গ্রেডের ছাত্রছাত্রীদের একেকটি দেশের উপর বিশেষ এসাইনমেন্ট দিয়ে ঐ দেশ সম্পর্কে পুরো জ্ঞানদানে উদ্বুদ্ধ করা হয়। লক্ষ্যবিন্দু হচ্ছে একজন মার্কিনি যাতে বড়ো হয়ে ঐ রাষ্ট্র, ঐ ভাষার সারটুকু আহরণ করে যুক্তরাষ্ট্রের কল্যাণে কাজে লাগাতে পারে।
দুই.একটি রাষ্ট্রের ভাষা কি বদলে যায়? ভাষা কি আধুনিক হয়? এসব প্রশ্নগুলো আমরা মাঝে মাঝেই দেখি। বাংলা সাহিত্যে একটি নতুন ট্রেন্ড শুরু হয়েছে ‘কবিতার ভাষা’। বিভিন্ন সাহিত্য সাময়িকী, লিটল ম্যাগাজিনগুলো ‘কবিতার ভাষা সংখ্যা’ প্রকাশ করছে মাঝে মাঝে। একটি ভাষায়, অন্য ভাষার ঘনিষ্ঠ প্রভাব পড়াটা খুবই স্বাভাবিক। বাংলা ভাষায় অনেক ইংরেজি প্রতিশব্দ মিশে আছে, যা এখন আমরা বাংলা বলেই মনে করি।
ভাষার বদলে যাওয়া সম্পর্কে যুক্তরাষ্ট্র অভিবাসী সুইডিশ একজন ভাষা বিজ্ঞানী এডলফ মেকিনসের ভাষ্য হচ্ছে­ যেহেতু অক্ষর, শব্দগুলো বদলায় না­ অতএব মৌলিক ভাষা বদলাবার কোনে সম্ভাবনা নেই। যা বদলায় তা হচ্ছে বাক্য গঠনের ধরন। চিত্রকল্পের ব্যবহার এবং বাক্য প্রকরণের গতিবিন্যাস। যে কবি অনুপ্রাস কিংবা নেপথ্য চিত্রের আধুনিক বিন্যাস ঘটিয়ে কবিতা লিখছেন, তিনিই দাবি করছেন­ তিনি নতুন ভাষায় লিখছেন। যদিও শুধুমাত্র তার বলার ধরনটি বদলেছে। বাংলা সাহিত্যে বিদেশী গল্প, কবিতা, উপন্যাসের ছায়া অবলম্বন করে অনেক গল্প, কবিতা, উপন্যাস, নাটিকা রচিত হয়েছে। মনে রাখতে হবে, একটি অন্যভাষার লেখা যখন পাঠকের মনে দাগ কাটে, তিনি যদি লেখক হন­ তবে তার আগামী লেখায় এর কিছু প্রভাব পড়তে পারে। প্রজন্ম থেকে প্রজন্মাìত্মরে এভাবেই ছড়িয়ে পড়ছে ভাষার বিবর্তনের আলো। অন্যভাষার দ্যূতিময় সারবস্তুকে নিজ ভাষার পাঠকের জন্য তুলে আনাকে এমন দোষের কিছু বলে, বৃহৎ সাহিত্য ভাণ্ডার বিবেচনা করে না।বাংলাদেশে গেলো দুই দশকে নামী-দামি বিদ্যালয়গুলোতে ইংরেজি শিক্ষার প্রসার বেড়েছে। বিশ্বের বর্তমান প্রবাহমানতার নিরিখে ইংরেজি শিক্ষা অত্যাবশ্যক বলেই আমি মনে করি। কারণ ইংরেজি শিক্ষার মাধ্যমে একজন শিক্ষার্থী খুব সহজেই সমসাময়িক বিশ্ব স্ট্যান্ডার্ডকে মোকাবিলা করতে পারে। নিজেকে খাপ খাওয়াতে পারে। আর রাষ্ট্রের সর্বক্ষেত্রে বাংলা ভাষার প্রয়োগ সম্পর্কে প্রথমে যে কথাটি আসে, রাষ্ট্রের আইনি প্রক্রিয়া, দলিল দস্তাবেজ এখনো যখন সেই ব্রিটিশ শাসনের ছায়া নির্ভর, সেখানে শুধু ভাষা পরিবর্তনের কথা আসছে কেন? বদলালে তো আমূল বদলে দিতে হবে পুরো দলিলপত্র, প্রক্রিয়া। বিজ্ঞান-প্রযুক্তির কল্যাণে বদলে যাচ্ছে গোটা বিশ্বভাষা পরিস্ফুটনের দৃশ্যকল্প। ছাপা বই প্রকাশনার পাশাপাশি এখন ইন্টারনেটে ই-বুক প্রকাশের প্রক্রিয়া ত্বরান্বিত করেছে পাঠকের তৃষ্ণাকে। এখনো এক সঙ্গে একই সময়ে বিশ্বের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে লাখ লাখ পাঠক-পাঠিকা একই বই পড়তে পারছেন। মেধা এবং মনন বিকাশে তাই ভাষার বিস্তার ছড়িয়ে পড়ছে বিশ্বের এক প্রান্ত থেকে অন্যপ্রান্ত পর্যন্ত।
এই সুযোগকে কাজে লাগিয়ে বাংলা ভাষা, বাংলা সাহিত্য এবং সংস্কৃতির ঐতিহ্যকে যদি ভাষাìত্মরের মাধ্যমে বিশ্বের অন্য ভাষাভাষী মানুষের কাছে ছড়িয়ে দেওয়া যায়। তবেই উপকৃত হতে পারে বাংলাদেশ, বাংলা ভাষা। শুধু ভাষার সৌন্দর্যই নয়, রাষ্ট্রের অবকাঠামোর সৌন্দর্য, স্খিতিশীলতা এবং শান্তির অব্যাহত ধারা বহাল থাকলে বাংলাদেশও হতে পারে বিশ্বের অন্যতম বিনিয়োগ, পর্যটন এবং বাণিজ্য নগরী। আর সেজন্য রাষ্ট্রীয়, রাজনৈতিক সদিচ্ছার প্রয়োজনীয়তা থেকেই যাচ্ছে। আমি মনে করি, প্রজন্মকে ভাষাপ্রেমে উদ্বুদ্ধ করতে হলে আগে সামাজিক নিরাপত্তা, শিক্ষার উজ্জ্বলতা দিতে হবে। সকল বাধা সরিয়ে নিতে হবে। শুধু অর্জন নিয়ে বসে থাকলেই চলবে না, অর্থনৈতিক, সামাজিক মুক্তিই দিতে পারে ভবিষ্যৎ প্রজন্মের শান্তির নিবাস।

জাতীয় সরকারের উদ্যোগ বনাম জাতির স্বপ্নমঙ্গল

জাতীয় সরকারের উদ্যোগ বনাম জাতির স্বপ্নমঙ্গল
ফকির ইলিয়াস
==================================
বাংলাদেশে অদূর ভবিষ্যতে যদি জাতীয় সরকার গঠিত হয় তবে এর কাঠামো কেমন হতে পারে? এ নিয়ে একটি ধারণা পাওয়ার চেষ্টা করছেন অনেকেই। মিডিয়া, লেখক, সাংবাদিক সবাই বিশ্লেষণ করছেন নিজ নিজ দৃষ্টিকোণ থেকে। বিশ্বের বিভিন্ন গণতান্ত্রিক দেশের জাতীয় সরকারগুলোর রূপরেখা এবং কর্মযজ্ঞ বিশ্লেষণ করলে দেখা যায়, রাজনৈতিক দূরদর্শিতা এবং প্রাজ্ঞতাই এসব সরকারকে ক্ষমতায় কিছুদিনের জন্য টিকে থাকতে সাহায্য করেছে। পরস্পর সহনশীলতা মোটামুটিভাবে কিছুদিন ‘জাতীয় সরকারকে কাজ করার সুযোগ দিয়েছে; কিন্তু সেসব ঐক্য খুব দীর্ঘ হয়নি।’প্রতিবেশী ভারতের প্রধানমন্ত্রী যখন চন্দ্রশেখর দায়িত্ব নিয়েছিলেন তখন সে দেশে একটি জাতীয় সরকারের ছায়া গড়ে উঠেছিল। কিন্তু নানা মতদ্বৈততার কারণে চন্দ্রশেখরের সরকার মাত্র কয়েক মাসই ক্ষমতায় থাকতে পেরেছিল।বাংলাদেশে জাতীয় সরকার গঠন করার মতো আদৌ কোন সুযোগ আছে কি? এ বিষয়ে আরো বিস্তারিত কিছু আলোচনা করা প্রয়োজন মনে করি। প্রথমত একটি দেশে তারাই জাতীয় সরকার চায়, যাদের দল গণতান্ত্রিকভাবে জনগণের কাছে দুর্বল অবস্খানে থাকে। কারণ তারা জানে, ভোটে জিতে কোন দিনই ক্ষমতায় যাওয়া যাবে না। তাই জাতীয় ঐকমত্যের মাধ্যমে যদি ক্ষমতার স্বাদ আস্বাদন করা যায়। বাংলাদেশে গণভিত্তিহীন রাজনৈতিক দলগুলোর এমন আগ্রহ অতীতে দেখা গেছে। বর্তমানে দেখাচ্ছে। ভবিষ্যতেও দেখা যাবে।আর এই জাতীয় ঐক্য, সংহতির তথাকথিত বাণী আওড়িয়ে যে দলটি বাংলাদেশে সবচেয়ে বেশি রাজনৈতিক সুবিধা নিয়েছে সে দলটির নাম জামায়াতে ইসলামী। জাতির জনক বঙ্গবু হত্যার পরপরই সামরিক জান্তাদের ছায়াতলে পুনর্বাসিত হয়ে জামায়াতি রাজাকাররা প্রথমেই বলেছে­ ‘আসুন ঐকমত্যের ভিত্তিতে বাংলাদেশকে গড়ে তুলি।’ তারা তাদের জঘন্য কৃতকর্মের জন্য ক্ষমা না চেয়েই, অনুতপ্ত না হয়েই বলতে চেয়েছে­ আসুন দেশকে এগিয়ে নিয়ে যাই! যারা এই রাষ্ট্রকে স্বাধীন হতেই দেয়নি, তারাই কি না অতীত ভুলে যাওয়ার আহ্বান জানায়! তারাই কি না দেশকে এগিয়ে নেয়ার হুঙ্কার হাঁকে!সেই ঐক্যের দোহাই দিয়েই রাজাকার শাহ আজিজ, মশিউর রহমান যাদু মিয়ারা মন্ত্রিত্ব পেয়েছিল। দীর্ঘদিন পর সেই একই কায়দায় জাতীয় সংহতির ঐক্যের ডাকে গড়ে উঠেছিল বিএনপি-জামায়াত চারদলীয় ঐক্য। একাত্তরের আলবদর কমান্ডার মতিউর রহমান নিজামী এবং আলী আহসান মুজাহিদরা মন্ত্রিত্ব পেয়েছিল­ সে দোহাই দিয়েই।এই জাতীয় ঐক্যের ভাগাভাগিতে জড়িয়ে পড়েছিলেন আওয়ামী লীগ নেত্রী শেখ হাসিনাও। ক্ষুদ্রাতিক্ষুদ্র জাসদের নেতা আ স ম রব এবং পতিত জাপার ভগ্নাংশের নেতা আনোয়ার হোসেন মঞ্জুকে মন্ত্রিত্ব দিয়ে তথাকথিত ‘জাতীয় ঐক্য গড়তে চেয়েছিলেন। এর ফলও শুভ হয়নি। তার প্রমাণ শেখ হাসিনা পেয়েছিলেন ২০০১-এর নির্বাচনে। যদি জনগণ জাতীয় ঐক্যকেই মেনে নিত তবে তো শেখ হাসিনার আবারো বিপুল ভোটে জেতার কথা ছিল। তিনি জিতবে পারলেন না কেন? কেন ভরাডুবি ঘটল তার দলের?দুই.ক্ষমতার জন্য রাজনীতি করা আর জনগণের মুক্তির জন্য রাজনীতি করা দুটি পৃথক বিষয়। কিন্তু ক্ষমতায় না গিয়ে জনগণের আশা-আকাáক্ষা পূরণ করা যায় না। প্রতিটি জাতির একটা নেপথ্য কাণ্ডারি শক্তি থাকে, যে শক্তি মেধা-মনন, সত্যবার্দিতা, নিষ্ঠা দিয়ে জাতির স্বপ্ন মঙ্গলের জন্য কাজ কৃের যান। এরা ক্ষমতার তোয়াক্কা না করেই মানুষের আশা-আকাáক্ষার পক্ষে দাঁড়ান। বাংলাদেশের রাজনৈতিক অঙ্গনে এ রকম স্বপ্নদ্রষ্টা রাজনীতিক বেশকিছু আছেন। কমরেড মণি সিংহ, কমরেড মোহাম্মদ ফরহাদ কিংবা শ্রী প্রসূন কান্তি রায় (বরুন রায়)­ এদের মতো মানবদরদি নেতারা বাঙালি জাতির গৌরব প্রদীপ বললে ভুল হবে না। অতি সম্প্রতি আমরা ঠিক সে কাতারেরই একজন নেতাকে চিরতরে হারালাম। তিনি সাইফউদ্দিন আহমেদ মানিক। সারাজীবন গণমানুষের কাতারে দাঁড়িয়েছেন নি:স্বার্থভাবে। বামপন্থি রাজনীতির এই পুরোধা ব্যক্তিত্ব জীবনের শেষ দিকে এসে ড. কামাল হোসেনের নেতৃত্বে গণফোরামে যোগ দেন। গণফোরাম বাংলাদেশে আপামর জনতার প্রিয় রাজনীতিক দলে রূপ লাভ করতে পারেনি। এর অনেক কারণ আছে। কিন্তু একজন নির্ভীক, আদর্শবাদী নেতা হিসেবে জনাব মানিক সবসময়ই জনগণের পাশে থেকেছেন। মহান মুক্তিযুদ্ধের অন্যতম সংগঠক এই মহান ব্যক্তি কালো পথে রাষ্ট্র ক্ষমতার ভোগবিলাস চাননি। অন্যায়ের সঙ্গে আপস করেননি। হয়তো তিনি ক্ষমতার ভাগিদার হতে পারেননি; কিন্তু তার কর্ম উদ্যম দিয়ে, আদর্শ দিয়ে বাঙালি জাতিকে যেভাবে প্রকৃত আলোয় প্রজ্বলিত করেছেন­ তা কি জাতি কোনদিন ভুলতে পারবে? না, তাঁর কর্মচেতনার ঋণ কোনদিন শোধ করা যাবে না।বাংলাদেশে মহান মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় বিশ্বাসী যারা রাষ্ট্র ক্ষমতায় ছিলেন­ তারা যদি অসাধু-অশুভ শক্তির সঙ্গে হাত না মিলিয়ে নীতিবান রাজনীতিকিদেরকে মূল্যায়ন করতেন তবে হয়তো আজকের প্রেক্ষাপট ভিন্নতর হতো। কিন্তু তারা তা করেননি। ক্ষমতায় যাওয়ার পরপরই তারা দলীয় মোসাহেবদের কবলে ব্যস্ত থেকেছেন ওদের লুটপাটকে সাহায্য করতে। আমার বারবার প্রশ্ন করতে ইচ্ছে করে শেখ হাসিনার মতো নেত্রী কেন চাটুকারদের কবলে পড়ে ব্যক্তিত্ব বিসর্জন দিয়েছিলেন? কেন বঙ্গবুর হাতে গড়া আওয়ামী লীগে এত বেশি তস্করবৃত্তির মানুষ ঠাঁই পেয়েছিল?তিন.সরকার নির্বাচনের দিকে অগ্রসর হচ্ছে। এ কথা বলছেন প্রধান উপদেষ্টা এবং প্রধান নির্বাচন কমিশনারও। এদিকে বিশেষ ক্ষমতা আইন শিথিল করে পৌরসভা এবং সিটি কর্পোরেশনে নির্বাচনের কথাও বলা হচ্ছে। যদি নির্বাচন করতে হয়, তবে তা কি সুষ্ঠুভাবে সম্পন্ন করা যাবে? বিশেষ করে সিটি কর্পোরেশন নির্বাচনে দলীয় প্রভাব পড়বে চরমভাবে, তা নিশ্চিত করে বলা যায়। বর্তমান প্রেক্ষাপটে পৌরসভা তো বটেই ইউনিয়ন পরিষদ নির্বাচনেও দলীয় তৃণমূল নেতাকর্মীরা ঝাঁপিয়ে পড়বেন এসব নির্বাচনে। তার কারণ ১৯৭১-এর পর, বড় দুটি দল বিএনপি এবং আওয়ামী লীগের অস্তিত্ব বাঁচাবার মতো নির্বাচনই অনুষ্ঠিত হবে ২০০৮ সালে। ১৯৭১-এর কথা এজন্য বলছি, কারণ তখন স্বপ্ন একটাই ছিল­ স্বাধীন বাংলাদেশ। আর এখন বিএনপি, আওয়ামী লীগ সমর্থকদের লক্ষ্য একটাই, তাদের নেত্রীদের মুক্তি।বর্তমান সরকার যদি তাদের মত না পাল্টান তবে নিশ্চিত করে বলা যায়, একটা পরিকল্পিত নির্বাচন অনুষ্ঠান করে একটি কোয়ালিশন সরকার ক্ষমতায় আসবে এবং সম্মিলিত বাহিনী সে সরকারকে ব্যাকআপ করে যাবে। এভাবে চলতে পারে হয়তোবা দু’টার্ম অর্থাৎ দশ বছর। এর মধ্যে চলতে থাকবে রাজনীতিক শুদ্ধি অভিযান। সে অভিযানের মাধ্যমে বড় দলগুলোকে শুধরিয়ে আনার চেষ্টা করা হবে। আর যদি বর্তমান শীর্ষ পর্যায়ে মত পরিবর্তন হয়­ তবে কোন বড় দলের নেতৃত্বে জাতীয় সরকারের আদলেই গঠিত হতে পারে আগামী সরকার। ক্ষমতায় যেই আসুক বাংলাদেশ ও বাঙালি জাতির স্বপ্ন মঙ্গল কতটা সাধিত হবে, তা নিয়ে প্রশ্ন বাড়ছে বৈ কমছে না। সেনাপ্রধান জে. মইন উ আহমেদ বলেছেন, তারা বেশিদিন থাকবেন না। কিন্তু কাউকে না কাউকে তো আসতে হবে। কারা আসবেন, তাদের পূর্ব প্রস্তুতি কতটা সম্পন্ন হয়েছে।দেশে জরুরি অবস্খা তুলে নিলেই অবস্খা দ্রুত পাল্টে যেতে পারে। রাজনীতিক কর্মকাণ্ডের পাশাপাশি কোন মধ্যস্বত্বভোগী চক্র সহিংসতা ছড়াতে তৎপর হতে পারে। হিংস্র জঙ্গিবাদীদের হামলে বৃদ্ধির সম্ভাবানাও উড়িয়ে দেয়ার মতো নয়।সব মিলিয়ে একটি অনিশ্চিত শঙ্কার দিকেই অগ্রসর হচ্ছে বাংলাদেশ। কারণ নির্বাচন করতে হলে, জরুরি অবস্খা ক্ষমতা আইন তুলতে হবে। আর তা তুলে নিলে আবার দেশ সহিংসতার দিকে যেতে পারে। যারা ক্ষমতায় আছেন, তারা সার্বিক অবস্খা বিবেচনা করেই অগ্রসর হবেন বলে সাধারণ মানুষ মনে করছেন।কারণ কে জিতবে, কে ক্ষমতায় আসবে তা বড় কথা নয়। বড় কথা হচ্ছে, জাতির নিরাপত্তা এবং স্বপ্নপূরণ। তিন যুগ পরও এ প্রত্যাশাটি কি খুব বেশি?
-------------------------------------------------------দৈনিক সংবাদ। ঢাকা। ১৩ফেব্রুয়ারি২০০৮,বুধবার প্রকাশিত